পঙ্কিসি ভ্যালি যেভাবে হয়ে উঠলো পর্যটন কেন্দ্র

|

একসময় এ অঞ্চল নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত ছিল। মুখরোচক সেসব গল্প মানুষের মুখে মুখেও ফিরতো। কেউ কেউ বলতো সন্ত্রাসের জনপদ। বলছি পঙ্কিসি ভ্যালির কথা।

হ্যাঁ, অনেকেই জর্জিয়ার এই ভ্যালিকে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হিসেবেই চিনতো। এখন সে জায়গা শান্তি, আতিথিয়তা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নতুন গন্তব্য। কিস্ত সম্প্রদায়ের গ্রামগুলোতে পর্যটকরা এখন সুফি আচারে মজে থাকছেন। সেখানকার পাহাড়ি পথ পর্যটকদের মন ভুলিয়ে দিচ্ছে। আর সঙ্গে নিচ্ছেন স্থানীয় খাবারের লোভনীয় স্বাদ।

পঙ্কিসির একটি ছোট গ্রাম, দুইসি-তে প্রতি শুক্রবার হয় ‘ধিকর’ অনুষ্ঠান। এটি একটি সুফি স্মরণানুষ্ঠান, যেখানে নারীরা নিজেদের আত্মাকে সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি আনার চেষ্টা করেন। আরবী ও চেচেন ভাষায় শান্তির গান গেয়ে তারা ধীরে ধীরে কণ্ঠে, ক্লাপে ও ঘূর্ণনে তন্ময় হয়ে যান। এই আচার ককেশাস অঞ্চলে নারীদের দ্বারা পরিচালিত একমাত্র ধিকর অনুষ্ঠান।

২০ বছর আগে, এই পঙ্কিসি উপত্যকায় কেউ ঘুরতে আসার কথা কল্পনাও করতো না। একে ‘আইনহীন’ অঞ্চল বলে সংবাদমাধ্যমে চিহ্নিত করা হতো। ট্রাভেল অ্যাডভাইজরিতে সতর্ক করা হতো এখান থেকে দূরে থাকার জন্য। কারণ, ২০০০ সালের শুরুর দিকে রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসা চেচেন উদ্বাস্তুদের আশ্রয়স্থল হয়েছিল পঙ্কিসি। সঙ্গে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, এখানেই নাকি আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন লুকিয়ে ছিলেন!

এমন পরিস্থিতিতে জর্জিয়া সরকার মার্কিন ও রাশিয়ার চাপে বিশেষ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালায়। তবে স্থানীয় কিস্তদের দারিদ্র্য ও সামাজিক সমস্যা উপেক্ষিতই থেকে যায়।

পঙ্কিসি ভ্যালির পাহাড়ি এলাকা মন কাড়বে পর্যটকদের

এরপর অনেক চেচেন পরিবার ইউরোপে চলে যায়। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে কয়েক ডজন যুবক আইএসের প্ররোচনায় সিরিয়ায় পাড়ি জমায়। তাদের মধ্যে ছিলেন আবু ওমর আল-শিশানি, যিনি আইএসের অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন। ফলে পঙ্কিসি আবারও সন্ত্রাসের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রচারে আসে।

তবে বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ২০২০ সালের এক ড্যানিশ অভিবাসন মন্ত্রণালয়ের রিপোর্টে বলা হয়—পঙ্কিসিতে অপরাধের হার খুবই কম। এটি এক শান্ত অঞ্চল। স্থানীয়দের ভাষায়, এখানকার পুলিশ শুধু চা পান করেই দিন কাটায়।

বর্তমানে স্থানীয়রাই পঙ্কিসির গল্প বদলে দিচ্ছেন। তারা পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, নিজেদের সংস্কৃতি দেখাচ্ছেন। ঘোড়ায় চড়ে, গান গেয়ে, ডাম্পলিং বানিয়ে তারা বলছেন—পঙ্কিসি এখন বদলে গেছে।

এই পরিবর্তনের অগ্রণী মুখ হলেন নাজি কুরাশভিলি। ২০১৩ সালে তিনি প্রথম পঙ্কিসিতে অতিথিশালা ‘নাজিস গেস্টহাউস’ চালু করেন। পর্যটন মন্ত্রণালয়কে উদ্বুদ্ধ করেন পঙ্কিসিকে পর্যটন মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে। ২০১৮ সালে গড়েন পঙ্কিসি ভ্যালি ট্যুরিজম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন।

আজ পঙ্কিসিতে রয়েছে ৯টি গেস্টহাউস, বেশিরভাগই দুইসি ও জোকোলো গ্রামে। সেখানে অতিথিদের কিস্ত আতিথেয়তা, সুস্বাদু ঘরোয়া খাবার ও স্থানীয় সংস্কৃতি উপভোগ করার সুযোগ মেলে।

পঙ্কিসিতে যাবার সেরা সময় মে থেকে অক্টোবর। শীতকালে অনেক গেস্টহাউস বন্ধ থাকে। তবুও কেউ এলে তারা পাবে ঘোড়ায় চড়ার সুযোগ, পাহাড়ে হাইকিং, সুফি ধিকর দেখার সৌভাগ্য এবং ঐতিহ্যবাহী রান্না শেখার ক্লাস।

পঙ্কিসি ভ্যালির অন্যতম আকর্ষণ এখানকার খাবার

কিস্ত খাবার হচ্ছে চেচেন ও জর্জিয়ান সংস্কৃতির মিশ্রণ। জনপ্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে ঝিঝিগ গালনাশ (ডো ও ভেড়ার মাংসের ঝোল), ও খিনকালি (এখানে মাংস নয়, ভর্তি করা হয় লতাপাতা)। প্রতিটি উপকরণই স্থানীয়—সবজি, মধু, দুধ, চিজ।

নাজির গেস্টহাউসে প্রতিরাতে এক কমিউনাল ডিনারে বসেন অতিথিরা। থাকে কিস্ত খাবার, ঘরে তৈরি গোলাপ ফলের বিয়ার, আর গল্প। কেউ পাহাড়ে হাঁটার, কেউ ঘোড়ার পিঠে চড়ার, কেউ বা ধিকর অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন।

আজ পঙ্কিসি ভ্যালি শুধু নতুন পর্যটন গন্তব্যই নয়, এটি আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়া এক সাহসী সম্প্রদায়ের গল্প। যারা প্রমাণ করে দিয়েছে, ভয় ও ভুল ধারণার ঊর্ধ্বে উঠে গড়ে তোলা যায় শান্তিপূর্ণ, অতিথিপরায়ণ এক সমাজ।

(বিবিসি’র ফিচার থেকে অনূদিত)

/এমএমএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply