
আল মাহফুজ⚫
‘শহরের উষ্ণতম দিনে
পিচগলা রোদ্দুরে
বৃষ্টির বিশ্বাস
তোমায় দিলাম আজ
আর কী বা দিতে পারি
পুরোনো মিছিলে পুরোনো ট্রামেদের সারি
ফুটপাথ ঘেঁষা বেলুনগাড়ি
সুতো বাঁধা যত লাল আর সাদা
ওরাই আমার থতমত এই শহরে
রডোডেনড্রন
তোমায় দিলাম আজ’
শহরের উষ্ণতম রোদ চড়চড় করা দিনে আপনি শুনেছেন এই গান। ফুটপাতে হাঁটার সময়ে বেলুনগাড়ি দেখলে আপনার মুখে এই গান গুনগুন বেজে ওঠে। বৃষ্টিস্নাত গভীর রাত, রিকশা ছুটছে ভেজা পিচ ধরে। গাদাগাদি করে বসা বন্ধুদের সঙ্গে আপনি কি গলা মেলাননি আত্মা-শীতল করা গানে? পাশ থেকে পুরোনো মিছিলের মতো ট্রাক ছুটছে আর আপনি বুঁদ হচ্ছেন পোড়া ডিজেলের আজন্ম আশ্বাসে..
‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ বা ‘তোমায় দিলাম’ নাম যেটাই হোক, আপনার কাছে সেটা গৌণ। মুখ্য ব্যাপার হলো– গানটা গাইলে গভীর রাতের নিয়ন আলোয় সব কিছু ধূসর মনে হয়। মুখ্য ব্যাপার হলো– গানটা যখন বেজে ওঠে, একান্ত গহীনে মনে পড়ে প্রিয় মানুষের মুখ। তখন শহরের সব থেকে উঁচু ছাদ থেকে ছিটকে পড়ে অতীন্দ্রিয় পুরাকীর্তি। পুবালি হাওয়ায় ভেসে চলে ঝালাই করা জলের জাহাজ..
আপনি হয়তো এতোদিন গানটাকে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র বলে জেনে এসেছেন। এখন যদি দেখেন, এই গান অন্য কারোর বলে আলোচনা চলছে, তাহলে মন খারাপ হবে? সম্প্রতি ‘শহর’ ব্যান্ডের অনিন্দ্য বোস সামাজিকমাধ্যমে স্পষ্ট স্বরে লিখেছেন, ‘তোমায় দিলাম’ নিয়ে অনেকেই ভুল মনে করেন। গানটা ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ বা তার দল ‘শহর’-এর গান নয়। এটা লিখেছেন জয়জিত লাহিড়ী, সুর করেছেন এবং গেয়েছেন সুব্রত ঘোষ।
ঘটনা সত্য। গানটার মূল কারিগর সুব্রত-জয়জিত ডুয়ো। তাদের দলের নাম ‘গড়ের মাঠ’। তবে যদি বলা হয়– থতমত এই শহরের গান ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’রও, সেটা কি মিথ্যে হবে? মনে হয় না। কারণ, এই গানসহ আরও অনেক বিখ্যাত গানের সঙ্গে মিশে আছে মহীনের ঘোড়াগুলির আদি ও প্রধান ঘোড়া গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের নাম। কীভাবে, তা জানতে যেতে হবে অন্তরালের গল্পে।
নগরবাসী যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, কলকাতার রাস্তায় তখন পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতেন জীবনানন্দ দাশ। তেমনই এক নিঃশব্দ রাতে দূরের আস্তাবল দেখে তার মনে ভাবের উদ্রেক হলো। নির্জনতার কবি লিখলেন—
আমরা যাইনি ম’রে আজো– তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন– এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ’পরে।

‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ নামটা এসেছে জীবনানন্দের লেখা এই ‘ঘোড়া’ কবিতা থেকে। ১৯৭৫ সালে কলকাতার নাকতলাতে পাড়ার এক অনুষ্ঠানে ‘সপ্তর্ষি’ নামে প্রথম স্টেজশো করে সাত তরুণ। এরপর দলের নামকরণ করা হয় ‘তীরন্দাজ’, ‘গৌতম চট্টোপাধ্যায় বিএসসি ও সম্প্রদায়’। পরে তারা ব্যান্ডের নাম রাখে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। এর নেতৃত্বে ছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়।
সত্তরের সেই সময়ে নকশাল আন্দোলনের মতোই এক অদ্ভুত স্থবিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল বাংলা গান। থমকে যাওয়া সেই সাগরে যেন উত্তাল ঢেউয়ের আভাস ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’তে। যাদের গান ভোকাট্টা হওয়া ঘুড়িকে ফেরালো চঞ্চল লাটাই প্রাণে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯-এর মধ্যে প্রকাশিত তিনটি অ্যালবামে সর্বসাকুল্যে তাদের গান ছিল ৮টি। এই কয়েকটি গান দিয়েই তারা নির্ধারণ করে দেয়, ভবিষ্যতের বাংলা গানের ধারা কোন পথে বইবে।
গৌতমের সঙ্গে ছিল বিশ্বনাথ-রঞ্জন ঘোষালরা। তাদের করা মিউজিক ছিল সময়ের চেয়ে এগিয়ে। গানে আমূল নতুনত্ব। বব ডিলানের মতো সৃষ্টিতে ব্যক্তিক আকুতি, সামাজিক প্রকৃতি। যদিও তাদের গানগুলোকে তখনকার শ্রোতারা মূল্যায়ন করতে পারেনি। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র নিজস্ব পোস্টবক্সে চিঠি এসে ভরে যেতো। তবে সেসব চিঠিতে তাদের গানের প্রশংসা নয়, থাকতো সমালোচনা। যেসব চিঠি সমন্বয় করে মহীনের দ্বিতীয় অ্যালবামের (অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব) কাভারও করা হয়েছিল।

শ্রোতারা মহীনের গান আপন করে না নেয়ায় এরপর বেশিদিন ব্যান্ডের কার্যক্রম এগোয়নি। একেক দিকে চলে যায় দলের একেক সদস্য। কেউ দেশ ছাড়েন, কেউ শহর ছাড়েন। কেউ ছাড়েন পুরোপুরি গানের জগত। কফিহাউজের সেই গানের মইদুল-নিখিলেশদের মতো ছন্নছাড়া দশা। তবে গৌতম চট্টোপাধ্যায় ঠিকই রয়ে যান কলকাতায়।
এরপর পদ্মায়-গঙ্গায় বহু জল গড়ায়। বসন্তের ঋতুচক্র ঘুরপাক খায় বহুবার। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডের অস্তিত্ব আছে কিনা, কেউ জানে না। সবাই প্রায় ভুলে গেছে তাদের নাম। সচেতন বিস্মরণের সেই মৌচাকে ঠিক যেন হুল ফোটালেন এক পাগলাটে তরুণ। নাম তার সুব্রত ঘোষ। তিনি খুঁজে বের করেন গৌতমকে। দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নেন ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র ব্যানারে নতুন করে গান প্রকাশের। গানগুলো গাইবে সমসাময়িক শিল্পী, নবাগত ব্যান্ড। আর পুরো বিষয়টির দেখভাল ও কিউরেট করবেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়।
শুরু হয়ে যায় অ্যালবামের কাজ। সেসব অ্যালবামে আর্টিস্টদের লিরিক, সুর ও সঙ্গীত আয়োজনে সাহায্য করেন গৌতম। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত ‘আবার বছর কুড়ি পরে‘। সেই অ্যালবামে বিখ্যাত হয় ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’ গানটি। এটাকে আপনি কার গান বলবেন? মহীনের? উত্তর হবে, হ্যাঁ। কারণ, এই গানের লিরিক ও সুর করেছেন দুজন। তার একজন মহীনের আদি ঘোড়া। অন্যজন পল্লব রায়। তবে গানটি পরিবেশন করে ‘ক্রসউইন্ডস‘ নামক একটি ব্যান্ড।

ঠিক এভাবেই ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত ‘ঝরা সময়ের গান‘। অ্যালবামের একটি গান ‘তোমায় দিলাম’, যা আজ মানুষের মুখে মুখে ফেরে (আজকের আলোচ্য বিষয়ও)। ‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ লাইন দিয়ে শুরু করা এই গানের লিরিক লিখেছেন জয়জিত লাহিড়ী, সুর করেছেন এবং গেয়েছেন সুব্রত ঘোষ। তাই ‘গড়ের মাঠ’কেই এই গানের মূল কারিগর বলা যায়। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়– এই গান কি ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ দ্বারা সম্পাদিত? উত্তর হবে, হ্যাঁ। যদি প্রশ্ন করা হয়– এই গানে লিরিক, সুর বা সঙ্গীত আয়োজনে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের প্রত্যক্ষ কিউরেশন কি নেই? এর উত্তর হবে, অবশ্যই আছে।
সুতরাং থতমত এই শহরের গানকে কেউ যদি মহীনের ঘোড়াগুলির গানও মনে করে, সেটা কি অসত্য হয়? সেই মনে করাটা পুরোপুরি ইনভ্যালিড হয়ে যায় কি? এছাড়া, মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত অ্যালবামগুলোতে যেভাবে একেকজন সুর বা কথা দিয়ে বা যন্ত্র বাজিয়ে অবদান রেখেছেন, তাতে এখানে সম্পূর্ণ নিজস্ব গান বলতে কিছু ছিল না।
এভাবে বিস্তর নতুন গান তৈরি হয় মহীনের ঘোড়াগুলির সম্পাদনায়। আবার ফিরে ফিরে আসে চেনা ঘণ্টাধ্বনি। এ সময় বাংলা ভাষার প্রথম ‘গিটার সিঙ্গার-সংরাইটার’ অরুণেন্দু দাসের মতো শিল্পীর গানের মহুয়ার স্বাদ আস্বাদন করে শ্রোতারা। তার করা কিছু গানের নাম না বলেই নয়– ‘কীসের এতো তাড়া’, ‘সারা রাত’, ‘গঙ্গা’, ‘তাই জানাই গানে’ প্রভৃতি।
মোটকথা, মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত অ্যালবামের সব গান হয়তো তাদের মৌলিক নয়। তবুও তারা সত্তরে যে মাইলস্টোন পেরিয়েছিল, নব্বইয়ে যে বেঞ্চমার্ক সেট করেছিল, বাংলা গানের ঘেরাটোপে তা অভূতপূর্ব। তারই ঝালর ফুল হলো ‘মানুষ চেনা দায়’ কিংবা ‘তোমায় দিলাম’। যেভাবে প্রাণের খোঁজে উঁকি দিয়ে দৃশ্যমান হয় সংবিগ্ন পাখিকূল; সেভাবে ধানের গন্ধে বিভোর শহরের উষ্ণতম দিন হেলে পড়ে কি ইমারতের ভিড়ে?



Leave a reply