
উঁচু ও প্রাণঘাতী দেয়াল দিয়ে ঘেরা গাজার তিন দিক। চতুর্থ দিকে রয়েছে সমুদ্র, যা দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এর জল ও মাছ দীর্ঘদিন ধরে বাইরের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন গাজাবাসীকে প্রয়োজনীয় প্রোটিন যুগিয়েছে।
কিন্তু আজ, এই সৈকত বাস্তুচ্যুতদের জন্য কোনো স্বস্তি বা আশ্রয় দেয় না। একসময় যেসব জেলেরা এখানে মাছ ধরত, ইসরায়েল এখন তাদের ভূমধ্যসাগরে যেতে নিষিদ্ধ করেছে—এভাবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যের উৎস থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে গাজাবাসীকে।
এই মাসের শুরুতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) একটি নিরাপত্তা আদেশ জারি করে গাজাবাসীদের জন্য সমুদ্রে সাঁতার কাটাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ইসরায়েলি বাহিনী প্রাণঘাতী শক্তি নিয়ে সৈকত পাহারা দিচ্ছে, ফলে কেবল চরম হতাশাগ্রস্তরাই মাছ ধরে বেঁচে থাকার জন্য সমুদ্রে যাওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে।
প্যালেস্টাইনের কঙ্কালসার শিশুদের ছবি দেখে বিশ্ব যখন হতবাক, আর ইসরায়েলের আচরণ নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা যখন বাড়ছে—গাজাবাসীর চিন্তা শুধু পরের বেলার খাবার জোগাড় করা। দুর্ভিক্ষের কিনারায় থাকা মানুষদের জন্য সমুদ্র এখন খাবারের একমাত্র উৎস, যদিও ইসরায়েল তা নিষিদ্ধ করেছে।
ইসরায়েলি নৌবাহিনীর ঝুঁকি সত্ত্বেও, কিছু জেলে সাহায্য বিতরণ কেন্দ্রের কাছে গুলিবিদ্ধ হওয়ার চেয়ে সমুদ্রে যাওয়াকেই বেছে নেয়।
গাজার এক জেলে জিয়াদ আবু আমিরা বলেন, ‘এছাড়া আমাদের অন্য কোনো খাবারের উৎস নেই। আজ যদি আমি আমার বাচ্চাদের জন্য মাছ নিয়ে না যাই, তাহলে আমি মরে যাব। আমি ট্রাকের পিছে দৌড়াবো না, এটাই আমার পথ।’
এমনকি মাছের ছোট একটি টুকরোও এখন অনেকের জন্য এক বেলার খাবার। সাত বছরের ফাইজার কণ্ঠ ক্ষীণ যখন সে জাল থেকে পাওয়া কিছু টুকরো হাতে নিয়ে বলে, ‘আমি জেলেদের সমুদ্র থেকে ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করি, তারা আমাকে কিছু দেয়। আমি প্রতিদিন আসি, একটু নিয়ে ফিরে যাই।’
সৈকতের অদূরে আট বছরের হুসাম সাদাল্লা তার নয় সদস্যের পরিবারের অপ্রত্যাশিত উপার্জনকারী। একটি জাল নিয়ে সে অগভীর জলে মাছ ধরে, মাঝে মাঝে হাতে কয়েকটি ছোট মাছ জড়ো করে। সে বলে, ‘আমি জাল ফেলি কারণ আমাদের খেতে হবে। আমি সবসময় নৌবাহিনীর জাহাজগুলোকে ভয় পাই। যদি আমরা একটু গভীরে যাই, তাহলে তারা গুলি করে।’.
গাজাবাসীরা এখন সমুদ্রে গেলে ইসরায়েলি নৌযান ও বিমান থেকে মৃত্যুর ঝুঁকি নেয়। মানবিক সংকট চরমে পৌঁছালেও, ২০২৩ সালের আগেই জেলেরা উপকূল থেকে দূরে যাওয়ায় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলি, গ্রেফতার ও হত্যার শিকার হতো।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, গত ২১ মাস ধরে ইসরায়েলের হামাসের সাথে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বেশিরভাগ মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়েছে, এবং উপকূল থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে মাছ ধরার সময়ও ফিলিস্তিনিরা লক্ষ্যবস্তু হয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সমুদ্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার পরও, জেলে জিয়াদ আবু আমিরা তার জাল মেরামত করতে করতে সিএনএনকে বলে, ‘আমরা দুই দিন পর ফিরে এসেছি। আমরা আমাদের শিশুদের ক্ষুধার্ত দেখতে পারি না।’
বছরের পর বছর ধরে গাজাবাসীরা এই প্রাকৃতিক সম্পদে অবাধ প্রবেশ করতে পারেনি। হামাসের সাথে উত্তেজনার সাথে সাথে ইসরায়েল মাছ ধরার সীমা পরিবর্তন করেছে—কখনো মাত্র তিন নটিক্যাল মাইল, আবার কখনো সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবরের আগে গাজায় বছরে প্রায় ৪,৬৬০ টন মাছ উৎপাদিত হতো। মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের জন্য এটি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং গাজাবাসীর জন্য প্রোটিনের একটি প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করতো। কিন্তু এখন, গাজার কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ইসরায়েলি বাহিনী মাছ ধরার নৌকা ও মৎস্য খামার প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে, ফলে উৎপাদন মাত্র ৬০ টনে নেমে এসেছে।
ভূমধ্যসাগরে গাজাবাসীর পক্ষে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের কিছু প্রচেষ্টা হয়েছে। ২০১০ সালে, তুরস্কের একটি বেসামরিক জাহাজ ব্লকেড ভাঙার চেষ্টা করলে ইসরায়েলি কমান্ডোরা জাহাজে হামলা করে নয়জন তুর্কি কর্মীকে হত্যা করে, যা বিশ্বব্যাপী তীব্র নিন্দার জন্ম দেয়।
এ বছর শুরুতে, জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গ একটি সাহায্য জাহাজে করে গাজার উপকূলে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা করলে ইসরায়েলি বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে ।
১৬ বছররের ইসমাইল আল আমৌদি এক জেলে পরিবার থেকে এসেছে। সে এখন ঢেউগুলোর দিকে অন্য চোখে তাকায়। ‘সবাই সমুদ্রে গেলে ভয় পায়,’ সে বলে। ‘আমরা আমাদের চোখের সামনে মৃত্যু দেখতে পাই।’
/এআই
সূত্র: সিএনএন নিউজ।
 
 
				
				
				 
 
				
				
			


Leave a reply