Site icon Jamuna Television

চিঠি দিনের কথা

ইব্রাহিম খলিল:

দরজায় ঠক ঠক করছে কেউ। খুলে দেখলেন চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে ডাকপিয়ন। হলুদ খামে কাগজের টাটকা গন্ধ। খাম খুলে চিঠি বের করার আগ পর্যন্ত এক অজানা চাপা উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা। সে অনুভূতি বড় ব্যাখ্যাতীত। চিঠি দিনের সেই অসাধারণ অনুভূতিগুলো এখন বিলুপ্ত। এখনকার শহুরে প্রযুক্তি আশ্রিত হৃদয়ে সে অনুভূতি জন্মায় না। আমরা বোধহয় এই অনুভূতিটা চিরতরে হারিয়েই ফেললাম। কারণ এখন আর এই শহরে কেউ কাউকে চিঠি লেখে না। সেটার প্রয়োজনও নেই আর।

এখনকার ডাক অফিসের মেঝেতে যে ক’খানা খামভর্তি চিঠি পড়ে থাকে তার প্রায় ষোল আনাই দাপ্তরিক। হয়তো খুব কালেভদ্রে দুএকটা ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসু চিঠি আসে এই ডাকঘরে- সুদুর অজপাড়া গাঁ থেকে। তবে তার বেশিরভাগই ভুল ঠিকানার দুর্ভাগ্যে প্রিয়জনের হাতের ছোঁয়া পায় না, চিরতরে হারিয়ে যায় ডাকের ভাঁগাড়ে।

কত বিবর্তন মানুষের অনুভূতির। কেউ বলবে ঠিকঠাকই আছে সবকিছু, প্রগতি আর প্রযুক্তি নিয়ে। আবার কেউ হয়তো বলবে ঠিক নেই সবকিছু, মৌলিক অনুভূতির জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে গঠনমূলক বিতর্ক চলতেই পারে। তবে যা হারিয়েছি তা কি আর কোনদিন ফিরে পাবো? কখনো কি ফিরে পাবো চিঠি খোলার সেই অজানা চাপা অনুভূতির পুনরাবৃত্তি?

নাহ, সেই একইরকম আর হবে না। প্রয়োজনের যোগাযোগ এখন মানুষ করতে পারে সেকেন্ডেরও কম সময়ে। এখন আর কাউকে অপেক্ষা করতে হয় না, ধৈর্য্যকে লালন করতে হয় না। চাওয়ার আগেই বার্তা মুঠোফোনের চকচকে ত্বকে টোকা মারে। এখন আর সেই অস্থিরতা উৎকণ্ঠার ফুসরত নেই।

এখন আর দূর দ্বীপবাসিনী প্রেমিকা বা নববধূকে চিঠির জন্য পথ পানে চেয়ে থাকতে হয় না। হয়তো প্রযুক্তি আমাদের “জরুরি” অভিপ্রায়টাকে মূল্য দিতে অপেক্ষাকে ছুটি দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু জরুরি বা খুব প্রয়োজনের বাইরে কি কিছু নেই? মায়া কি হারিয়ে যাচ্ছে? সে বিষয়ে দীর্ঘ বিতর্ক আলোচনা হতেই পারে।

তবে এখন আর কেউ হাতের লেখা চিঠির গোটা গোটা অক্ষরগুলো ছুঁয়ে দেখতে পারে না। সে অনুভূতি অনেকে জানেই না। চিঠি পড়ে নয়, কেবল কালো অক্ষরগুলো ছুঁয়ে কত চোখ বাষ্পিত হয়েছে। সে হিসেব কেউ রাখেনি। সেই বিরল অনুভূতি কি আর কখনো ফিরে আসবে?

চিঠির ভিতর গোলাপি সুবাস বা পাপড়ি কিংবা নববধূর চোখের জলভেজা কাজলের চিহ্ন, সেগুলো কি আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবে? মাঝে মাঝে এসব চিন্তা করলে বুকটা খুব হাহাকার করে ওঠে, খুব অস্থিরতা লাগে মস্তিষ্কে। আহারে, অনুভূতিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, আহারে!

তাই চিঠি লেখার জন্য একটা বিপ্লব হোক। এই শহরের মানুষ আবার চিঠি লিখুক। জরুরি, খুব প্রয়োজনীয় কাজের জন্য তো ফোন, ইন্টারনেট প্রযুক্তি দুনিয়া আছেই। তার বাইরে নিতান্ত ছোট প্রয়োজন বা অকারণে বা অপ্রয়োজনেও মানুষ চিঠি লিখুক। প্রিয় মানুষের ঠিকানায় মাত্র কয়েকটি টাকা খরচ করে হলেও চিঠি লিখে ফেলি আমরা। খুব প্রয়োজনীয় কিছু বলে না, এমনি কিছু পাদটিকার কথা, কিছু ফুরিয়ে যাওয়া কথা, যে কথা সামনা সামনি বলা হয়নি। চাইলেই লিখে ফেলা যায়।

লিখুন না গ্রামের মা বাবাকে একটা চিঠি বা প্রিয় কোনো মানুষকে। একবার চেষ্টা করেই দেখুন, হুট করে লিখে ফেলুন একটা চিঠি। কি এমন হয় তাতে। বেশ অফুরন্ত সময় আমাদের হাতে, একটা চিঠিইতো। হুট করে একটা সুন্দর দিনে লিখে ফেলুন। আবার তৈরি হোক “কলমবন্ধু”র গল্প। আসুক না ফিরে সেই বিলুপ্ত অসাধারণ অনুভূতিগুলো। এমন অন্তর্জালের দুনিয়ায় প্রিয় মানুষটা হঠাৎ পিলে চমকে যাক একটা চমৎকার চিঠি হাতে পেয়ে। হোক না একটু চিঠির বিপ্লব!

Exit mobile version