Site icon Jamuna Television

ঘরে ফেরা মানুষদের সমালোচনা করার আগে একটু ভাবুন

উপমা মাহবুব:

আমার ফেসবুক ওয়াল ভেসে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষের ঘরে ফেরার ছবিতে। পোস্টদাতারা সারা দেশে করোনা সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে যাবে এই আশঙ্কায় এই মানুষগুলোর সমালোচনা করছেন। কেউ কেউ বলতে বলতে ভদ্রতার সীমারেখা পেরিয়ে যাচ্ছেন। আচ্ছা আপনারা কী একবার ভেবে দেখেছেন, ঢাকা শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষকে কীভাবে লক ডাউন করা হবে? সবার জন্য খাবার, মেডিসিনসহ প্রয়োজনীয় জিনিস নিশ্চিত করার মতো সক্ষমতা কি সরকারের আছে? যারা রাস্তায় থাকে তারা কই যাবে। করাইল বস্তিতে যে লাখ খানেক মানুষ থাকে তাদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার উপায় কী হবে? আর সেখানে করোনা ছড়ালে কী হবে সেটাতো ভাবতেই পারছি না।

ছবিগুলো একটু খেয়াল করলেই দেখবেন বাড়ি যাচ্ছে মূলত নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত আর মেসে থাকে পড়ালেখা বা চাকরি করা মানুষেরা। গ্রামে গেলে এই পরিবারগুলোর একটা বড় অংশ অন্তত নিজের উঠানের সবজি-লাউ, বাড়িতে পালা মুরগি খেতে পারবে। ডিসেন্ট্রালাইজেশন হলে জেলাভিত্তিক খাদ্য বরাদ্দ করা এবং সেগুলো সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। এলাকাভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ এবং তাদের দিয়ে সেবামূলক কাজ করানোও সহজ হবে।

বলছি না যে যেভাবে মানুষ বাড়ি যাচ্ছে তা ঠিক। তবে এছাড়া কোনো উপায়ও দেখি না। এদের মাধ্যমে করোনা ছড়ানো নিয়ে মানুষের উদ্বিগ্নতা অমূলক নয় মোটেই। তবে সত্য হলো সারাদেশে করোনা যা ছড়ানোর তা ইতিমধ্যেই প্রবাসীদের মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে। সর্বনাশ যা হওয়ার তা আগেই হয়ে গেছে এখন এই মানুষগুলোর বাড়ি ফেরার মাধ্যমে সর্বনাশের মাত্রা একটু বাড়তে পারে আবার নাও পারে। এতোটুকুই।

আমার মনে হয় না শহুরে ধনী বা সম্পন্ন পরিবারের কেউ এই ভিড় ঠেলে বাড়ি যাচ্ছেন। তারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিজের পরিবার-পরিজনকে নিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তরাও তাদের মতো তাদের পরিবারের সুরক্ষা নিয়ে চিন্তা করছে। আমরা মানে শহুরে মানুষ বা সরকার কেউই যেহেতু এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে ঢাকা শহরের মতো একটা বসবাস অনুপযোগী শহরে হোম কেয়ারেন্টাইন করে তাদের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসার নিরাপত্তা দিতে পারবো না, অতএব এই মানুষগুলোকে তাদের মতো করে করোনা থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে দেওয়াই ভালো। তাদের বাড়ি ফেরা নিয়ে সমালোচনা করা বাদ দিয়ে বরং আপনার বাড়ির গৃহসহকারী, ড্রাইভারদের বেতন ঠিকমতো বুঝিয়ে দিন। আপনার বাড়িতে নিম্নবিত্ত পরিবার ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকলে তাদের বাড়িভাড়া মওকুফ করে দিন। যেসব দরিদ্র মানুষ ঢাকায় থেকে যাবেন, রিক্সা চালাবেন, শহর পরিষ্কার করবেন, তারা যেন যথাযথভাবে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এই কাজগুলো করতে পারে, হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকলে দু’বেলা খেতে পারে সেই লক্ষ্যে আপনি কী অবদান রাখতে পারেন তা নিয়ে ভাবুন। যেসব সংস্থা বা ব্যক্তি ইতিমধ্যে করোনা সংকট মোকাবেলায় নানা রকম সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাদের অর্থ সহযোগিতা করুন। একটি ফেসবুক গ্রুপের পোস্টে দেখলাম পরিস্থিতি ঠিক হলে বাড়ি থেকে ফিরে আসা গৃহসহকারী করোনা নিয়ে আসবে কিনা কেউ কেউ সেই চিন্তা এখনই করতে শুরু করেছেন। দয়া করে শুধু নিজের ভালো চিন্তা করা বাদ দিয়ে গরীব মানুষের প্রতি একটু সদয় হোন। নিজের পরিবারের নিরাপত্তাকেই শুধুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে অন্যদের দিকেও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিন। বাড়িতে চলে যাওয়া আপনার গৃহকর্মীর খবর রাখুন। তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিন, প্রয়োজনে অর্থ সহযোগীতা করুন। কাপড়-চোপড় বিক্রির অনলাইন পেজে পাকিস্তানি পোশাকে লাইক দেওয়ার বদলে একই পেজে করোনা নিয়ে একটি সচেতনতামূলক পোস্ট আসলে তাতে একটা লাইক দেওয়ার অভ্যাস করুন।

বাংলাদেশে সরকারের একার পক্ষে করোনা সংকট মোকাবেলা সম্ভব না। এটা একটা জাতীয় দুর্যোগ। সম্মিলিতভাবে এই সংকট মোকাবেলায় কাজ করতে হবে। পহেলা বৈশাখ বা ঈদের জামাকাপড় কেনার ধুম কমিয়ে, বাসায় বসে পা নাড়িয়ে টিভি দেখে আর সরকারের সমালোচনা না করে, নামাজ পড়া, আড্ডা দেওয়া বা চা-সিগারেট খাওয়ার জন্য দিনে দশবার বাড়ির বাহিরে বের না হয়ে বরং ঠাণ্ডা মাথায় একটু নিজের মন আর মগজের সমন্বয় করুন। দেখবেন আপনার সামনে বাসায় বসেই করোনা সংকট মোকাবেলায় অবদান রাখার অনেক পথ বেড়িয়ে এসেছে। অনুভব করবেন নিজের মনে জোর পাচ্ছেন৷

হয়ত আপনার অবদানটা হবে খুবই ক্ষুদ্র। হয়ত এগুলো সমস্যা সমাধানে তেমন করে কোনো কাজেই আসবে না। হয়ত রাস্তায় নেমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে গেলে আপনার নিজের এবং আপনার পরিবারের রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। তবু মনের শান্তির জন্য, দেশের ১৭ কোটি মানুষের কথা ভেবে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগ আমাদের নিতেই হবে। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে, আমরা কী ঘুরে দাঁড়াবো নাকি মরার আগেই আতংকে ডুবে মরে যাব তা তাই এখনই ঠিক করতে হবে। এটা ঠিক সময় চলে যাচ্ছে। তবে এটাওতো ঠিক যে ভালো কাজ শুরুর কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। যেকোনো সময় যেকোনো অবস্থা থেকেই মানবকল্যাণে এগিয়ে আসা সম্ভব। আর কে না জানে,’ছোট ছোট বালু কণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল’।

লেখক: কলামিস্ট এবং উন্নয়ন পেশাজীবীী।

Exit mobile version