Site icon Jamuna Television

‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব কৃষক’

আলমগীর স্বপন:

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জনপ্রশাসনে সজ্জন, কর্মঠ ও নীতিবান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গত অক্টোবরে তিনি অবসরে গিয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গত ২২ জানুয়ারি তার একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে অনেককেই অবাক করেছে। কী স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করা সাবেক এই কর্মকর্তা? একটু চোখ বুলিয়ে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসে অনেকটা মনোকষ্ট নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘সহকর্মীদের সঙ্গে প্রবাস থেকে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম তাদের বেশিরভাগই অপরিচিত কল ধরেন না, মেসেজ পড়ে দেখেন না বা উত্তর দেন না। আমরা কি এ সংস্কৃতি হতে বের হতে পারি?’

অথচ এই স্ট্যাটাসের মাত্র তিন মাস আগে তার ফোন পাওয়া শুধু নয়, তিনি ফোন ধরলেই অধীনস্থ কতো কর্মকর্তা খুশিতে আটখানা হতেন। এরকম কত শত সহকর্মীকে সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিবের রুমের সামনে লাইন ধরে থাকতে দেখেছি। তার একটু মনোযোগ পেতে তারা নানা চেষ্টা করেছেন, কৃপায় ধন্য হয়েছেন। ‘স্যার, স্যার’ বলে মুখে ফেনা তুলেছেন কেউ কেউ। না চাইতেও তার কাছে ছুটে গেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ নিয়ে। কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তন হওয়ায় এই তৈল মর্দনকারী আমলারা পল্টি দিয়েছেন। কেনো? এর উত্তর খোদ সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব দিয়েছেন, এর জন্য তিনি দায়ী করেছেন প্রশাসনের চলতি সংস্কৃতিকে। সেই সংস্কৃতি এখন কতটা ভয়ংকর রুপ নিয়েছে? লতাগুল্মে বংশবিস্তার করে সাধারণ মানুষকে পরগাছা হয়ে কীভাবে জাপ্টে ধরছে? এর আরেক রূপ আমরা দেখলাম যশোরের মনিরামপুরের এসি ল্যান্ডের কর্মকাণ্ডে। বাবার বয়সী তিন বৃদ্ধকে তিনি কান ধরতে বাধ্য করেছেন। অপমান করেছেন। আবার সদর্পে সেই ছবি তুলেছেন। প্রশাসনিক ওয়েব পোর্টালে এর ছবিও আপলোড করেছেন। লক্ষ্য একটাই, করোনা প্রতিরোধে কতোটা কর্মঠ ও আইন বাস্তবায়নে কতটা উদ্যোগী এর জানান দেয়া। উর্ধ্বতনদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা এতে পরিস্কার। কিন্তু এই অপকর্ম করতে গিয়ে মানবিকতা, সংবিধান ও সরকারের নির্দেশনা কীভাবে পায়ে দলেছেন সেই ভেদবুদ্ধি যে-এই এসিল্যান্ডের ছিলো না, বাবার বয়সীদের সাথে তার অপমানজনক আচরণেই বোঝা যায়।

ধরাকে সরা জ্ঞান করে এমন কাজ করতে গিয়ে তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। সংবিধানের ২১(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য৷’। এই কর্তব্য নাগরিকরা যেন পালন করে। আইনের মধ্যে থেকে এর বাস্তবায়ন করবেন প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেবার মানসিকতা নিয়ে সেই দায়িত্ব যে পালন করতে হবে ২১(২) ধারায় সহজ করেই বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য’। কিন্তু আইন মানাতে গিয়ে এসি ল্যান্ডের কর্মকাণ্ডে সেবার মানসিকতা একেবারেই ছিল না। আবার করোনার বিস্তৃতি ঠেকাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনাও এক্ষেত্রে লঙ্ঘন করেছেন। কেবিনেট বিভাগের ১০ নির্দেশনার প্রথমটিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি ছুটির আওতামুক্ত থাকবে কাঁচাবাজার। অথচ সেই প্রবীণদের একজন কাঁচাবাজার নিয়েই বসেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার তাপে বেমালুম সব ভুলে গিয়ে পুরো প্রশাসনকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন এসি ল্যান্ড সাইয়েমা হাসান। শুধু এই এসি ল্যান্ড নয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজনের মাঝেও দেখছি ডাণ্ডা দিয়ে ঠাণ্ডা করার মানসিকতা। দেদারসে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে জখম করছেন দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষকে। ভারতেও এমন দেখা গেছে। এতে আমাদের মতো কিছু মানুষও উল্লসিত হয়েছেন। বলতে চেয়েছেন, ‘যেমন কুকুর, তেমন মুগুর।’ কিন্তু এরকম মানসিকতা, মনোভাবে শুধু দৈন্যতাই প্রকাশ পায়। এভাবে আইন মানাতে গিয়ে, আইনের লঙ্ঘন হয়, সঠিক প্রয়োগ হয় না, তা বুঝতে হবে প্রশাসনের মুষ্টিমেয় সেইসব কর্মকর্তাদের।

তবে এতোক্ষণ প্রশাসনের যে চিত্র তুলে ধরলাম, অন্ধকার দিক নিয়ে আলোচনা করলাম এর বাইরের আলোর জগত অনেক বড়। খারাপের চেয়ে ভালোর সংখ্যাই বেশি। প্রশাসনের কত শত কর্মী দিনরাত খাটছেন করোনার বিস্তৃতি ঠেকাতে। কেউ কেউ নিজের টাকা খরচ করে সামর্থ্য অনুযায়ী নিম্ন আয়ের, দিনমজুর, দিন আনে দিন খায় এমন মানুষদের সহায়তা করছেন। চিকিৎসক, পুলিশ, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসক কর্মকর্তারা জীবনের তোয়াক্কা না করে এই দুর্যোগে কাজ করছেন। এর উদাহরণ অনেক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন ভালো করা কয়েকটি ছবিও দেখলাম, রাজশাহীর জেলা প্রশাসক হামিদুল হক, তানোর উপজেলার একজন বয়স্ক অভাবী মানুষকে আর্থিক সহায়তা করছেন। যাতে সেই দুস্থের দিন কয়েকের খাবার সংকুলান হয়।

লক্ষীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার ইউএনও মুনতাসির একজন মুচির হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন। এভাবে দরিদ্রের হাতে খাবার তুলে দেয়ার পাশাপাশি মানবিকতা প্রদর্শন করে করোনায় কেন ঘরে থাকতে হবে বোঝালে নিশ্চয়ই এই মানুষগুলো শুনবেন।

সেই বোধে পররাষ্ট্র ক্যাডারের এক ছোট ভাইকে দেখলাম, কয়েকজনের চেষ্টায় কিছু টাকার জোগাড় করে সাভারের ইসলামনগর বাজারে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করছেন। সচেতন করছেন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এমন নজিরের অভাব নেই দেশে।

সংবাদকর্মী হিসেবে পেশাগত কাজে সপ্তাহে তিন চারদিন আমার যেতে হয় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে। খবরাখবর দিতে হয়, প্রশাসনের ভালোমন্দের। এর মাঝে অনেক সরকারি কর্মচারীর সাথে পরিচয়-খাতির হয়েছে। তাদের কর্মনিষ্ঠা, ত্যাগ ও দায়িত্বশীল আচরণ কাছে থেকে দেখেছি। কিছু মন্দ মানুষও পেয়েছি। তবে বেশিরভাগই সজ্জন ও কর্মঠ। তাই মনিরামপুরের এসি ল্যান্ডের অপকর্মের পাল্লায় সবাইকে মাপতে চাই না। কিন্তু শঙ্কা এই যে, প্রশাসনে মন্দ মানুষের সংখ্যা কী বাড়ছে? সরকারের নীতি নির্ধারকদের অবশ্যই এদিকে মনোযোগ দিতে হবে। কিছুদিন আগে কুড়িগ্রামের ডিসি ও তার অধীনস্থ চার কর্মকর্তার কর্মকাণ্ডের স্মৃতি এখনও তাজা। কোনো আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে, মোবাইল কোর্ট আইন লঙ্ঘন করে মাঝরাতে এক সাংবাদিকের সাথে কী অমানবিক কাজ তারা করেছিলো পুরো দেশ জানে। এরকম অনেক কর্মকাণ্ড হয়তো আলোর মুখ দেখেনি।

সরকার একের পর এক এমন ঘটনায় যে বসে আছেন তা বলা যাবে না। বেশ কিছু ঘটনায় ব্যবস্থাও নিয়েছে। সবশেষ কুড়িগ্রামের ডিসি ও মনিরামপুরের এসি ল্যান্ডের দ্রুত শাস্তি এর বড় উদাহরণ। কিন্তু এরপরও কী এমন অভিযোগ সামনে পাওয়া যাবে না? সেই শঙ্কা অনেকের মাঝেই আছে। কেন্দ্র কিংবা মাঠ প্রশাসনের পেশাদারিত্ব, রাজনীতিকীকরণ নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু আগের চেয়ে কমেনি। অনেকের অভিযোগ বরং বেড়েছে। একে তারা ৫ জানুয়ারি ও ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের সাইডএফেক্ট হিসেবেও দেখতে চান। ক্ষমতাসীন দল করেন, পদ পদবী আছে এমন কয়েকজনের কাছ থেকে শুনেছি, আগের মতো এখন আর তারা ওসি, ইউএনও, পুলিশ সুপার ও ডিসির কাছে প্রাপ্য সমাদার পান না। তাদের আইন সম্মত নির্দেশনা, দাবি মানতেও নাকি গড়মসি করেন প্রশাসনের কোনো কোনো কর্তাব্যক্তি? দু্র্যোগের এই কঠিন সময়ে এসব কথায় আপাতত কান দিতে চাই না। বিশ্বাস করতে চাই না। শুধু মনোযোগ দিতে চাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে দেয়া জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের সেই দরাজ কণ্ঠের ভাষণে।

১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমরা গাড়ি চড়ি ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন। ওদের ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক, ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে। সরকারী কর্মচারীদের বলি, মনে রেখো এটা স্বাধীন দেশ। এটা বৃটিশের কলোনি নয়, পাকিস্তানের কলোনি নয়। যে লোককে দেখবে তার চেহারাটা তোমার বাবার মতো, তোমার ভাইয়ের মতো, ওদেরই পরিশ্রমের পয়সা, ওরাই সম্মান বেশি পাবে। কারণ ওরা নিজেই কামাই করে খায়।’ মুজিববর্ষে জাতির পিতার এই পথ নির্দেশনা মানলেই সমন্বিতভাবে মোকাবিলা করা যাবে ভয়ংকর কোভিড-১৯। সেই সাথে সঠিক পথে থাকবে সুর্বণজয়ন্তীর পথে থাকা প্রিয় বাংলাদেশ।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন।

Exit mobile version