Site icon Jamuna Television

কবিরা যা করতেন কোয়ারেন্টাইনে

মুরশিদুজ্জামান হিমু:

‘কোয়ারেন্টাইন’ নামে পৃথিবীতে একটি জটিল শব্দ আবির্ভূত হয়েছে। অসংখ্য মানুষ আজ অবদি গুগল করে জানছেন, কী এর মানে। সাদামাটা বাংলায়, রোগ ছড়িয়ে যেন না পড়ে, সে জন্য আলাদা থাকা, বিচ্ছিন্ন থাকা। কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন থাকা, আলাদা থাকা বা একা থাকায় কোনোভাবেই আমাদের মানানো যাচ্ছে না। পুলিশ দিয়ে আমাদের ঘরে রাখা যায়নি; র‍্যাবের সাইরেন বাজিয়েও না। শেষ পর্যন্ত নামলো সশস্ত্রবাহিনী। দেখা যাক, এরপরও আমাদের ‘কোয়ারেন্টাইন’ করা যায় কি না।

এবার, আসি মূল প্রসঙ্গে। প্রশ্ন উঠতে পারে কেন আমাদের ঘরে রাখা যাচ্ছে না? সমস্যাটা কোথায়? উত্তর আপাতত শিল্প-সাহিত্য, কবি-ঔপন্যাসিকদের দিয়ে খোঁজা যাক।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’। আবার রবিঠাকুরই লিখেছিলেন, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে…’। বোঝাই যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ঘরে আটকে রাখতে পছন্দ করতেন না। নানা অজুহাতে বাইরে বেরিয়ে পড়তে চাইতেন। আজ যদি রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতেন, তাহলে কোনো বাহিনী দিয়ে হয়ত তাকে ঠেকিয়ে রাখা যেত ঠিকই; কিন্তু বেরিয়ে আসতো ঘর থেকে বেরোনোর আর্তনাদমূলক কোনো চরণ।

এবার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা ধরা যাক। উনিতো আরও একধাপ এগিয়ে এক্ষেত্রে। যিনি লিখতে পারেন, ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট রক্ত-জমাট শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী!…’। তারপক্ষে আর যাই হোক, টানা ঘরে থাকা পছন্দ হতো না, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তার ওপর যে লোক লিখতে পারে, ‘লাথি মার ভাঙরে তালা’, উনি তো এমন সময়ে বিরক্ত হয়ে আরও অনেক কিছু ভাঙার কথা বলতে পারতেন। হয়ত ‘বিদ্রোহ’ও করে বসতেন।

জীবনানন্দও বোধহয় এমন লকডাউন পরিবেশে মানিয়ে নিতে খুব বেগ পেতেন। যিনি ঘুরে ঘুরে ‘বাংলার মুখ দেখিয়াছেন’, তার পক্ষে এমন পরিবেশ দম বন্ধ করার মতোই লাগতো। তারওপর বরিশালের ছেলে হয়েও যিনি ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে খুঁজতেন, তার পক্ষে লকডাউন মানা খুব কষ্টসাধ্যই হতো। এমন সময়ে তিনি থাকলে হয়তো রাস্তায় নেমে পুলিশকে শুনিয়ে দিতেন ‘পুলিশ ভাই, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি, বলনাকো কথা…’। হয়তো শেষে বলতেন, ‘তোমার হৃদয়ে আজ ঘাস, বাতাসের ওপারে বাতাস, আকাশের ওপারে আকাশ’।

লাখ লাখ মানুষ যে লকডাউন ঘোষণার পর শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়েছেন, তেমন বোধহয় করতেন জসীমউদ্দীনও। এমন সময় শহরের কমলাপুরের বাড়ি ছেড়ে ফরিদপুরের গ্রামে গিয়ে থাকতে চাইতেন তিনি। শুধু নিজে না, আশপাশের মানুষকেও বলতেন, ‘তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়…’। গ্রামে গিয়ে হয়ত কাজহীন মানুষ দেখে লিখে ফেলতেন, ‘পেটটি ভরে পায়না খেতে, বুকের ক’খান হাঁড়, সাক্ষী দেছে অনাহারে কদিন গেছে তার।’

কবিরা তো এমনই হয়। অন্যের কষ্ট দেখে কষ্ট পেয়ে কলম ধরে। তারপরও দিন শেষে হয়তো তারা বুঝতেন, এখন সময় অনুকূলে না। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিচ্ছে। তাই ঘরে থাকতে হবে। বাইরে বের হওয়া এখন রীতিমত অপরাধ। ছটফট করা উন্মত্ত মন হয়তো বিপদে ফেলতে পারে নিজেকে, পরিবারকে, দেশকে। তাই কবিমনের রাশ নিশ্চয়ই টেনে ধরতেন রবিঠাকুর-নজরুল-জীবনানন্দ-জসীমউদ্দীনরা। প্রত্যাশায় থাকতেন সুদিন ফেরার।

হয়ত রবিঠাকুর লিখেও ফেলতেন,
‘আমি আশায় আশায় থাকি
আমার তৃষিত-আকুল আখি…’।

Exit mobile version