Site icon Jamuna Television

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাঃ দায় কি শুধুই সরকারের ?

স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার না চাহিদা? বাংলাদেশে রাষ্ট্র আপনার স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে কতটুকু বাধ্য বা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার করুণ দশায় সরকার বা চিকিৎসা ব্যবসায়ীদের দায়ই বা কতটুকু? এরকম নানা প্রশ্ন আমাদের মাথায় ঘুরপাক খায় সারাক্ষণ। বিশেষ করে যখন সঠিক চিকিৎসা বা যথাসময়ে চিকিৎসা পেতে ব্যর্থ হই তখনই শুরুতেই ডাক্তারদের কসাই বলে শুরু শেষে সরকারকে দিয়ে শেষ করি আমাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

আর এমন কিছু প্রশ্নের সহজ করে উত্তর দিলেন একজন মাহমুদ রায়হান। পেশায় তিনি একজন সরকারি চিকিৎসক।

তার ফেসবুক থেকে নেয়া এসব প্রশ্ন উত্তর তুলে ধরা হলো পাঠকের সৌজন্যে….

একটা জিনিস লেখার আগেই ক্লিয়ার করে নেয়া ভালো – সেটা হল স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার কিনা? উত্তরটা হল সোজাসাপটা “না”!! চমকে গেলেন ? যেতেই পারেন । সন্দেহ দূর করার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানটা নেড়েচেড়ে দেখতে পারেন। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার বলে যা আছে তাতে বাকস্বাধীনতা, রাজনীতি করার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার , ধর্মের অধিকার এসব ভালো ভালো কথা থাকলে খাদ্য, বস্ত্র , বাসস্থান , শিক্ষা, চিকিৎসা একটি নেই। তাহলে এগুলি কি? এগুলি মৌলিক চাহিদা । এর মানে হল সরকারের এগুলি পূরণে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি না খেয়ে আছেন ? এজন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ করবেন ? পারবেন না। কারণ এটা আপনার অধিকার না, চাহিদা। সরকারের দায়িত্ব বাজারে পর্যাপ্ত খাদ্য বস্ত্র থাকবে সেটা নিশ্চিত করা , আপনি বাসমতী কিনবেন নাকি মোটা চাল সেটা দেখা বা নিশ্চিত করটা সরকারের কাজ না। তেমনি স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও এক ই কথা প্রযোজ্য । দেশে হাসপাতাল থাকবে এটা নিশ্চিত করা সরকারের কাজ, কিন্তু আপনি সরকারী হাসপাতালে যাবেন নাকি পাঁচতারা খুঁজবেন সেটা আপনার সামর্থ্য আর অভিরুচি। এইটুকু পরেই আমাকে গালাগাল দিতে আসবেন না, এটা ভূমিকামাত্র ।

**স্বাস্থ্যসেবা সরকার দেবে, বেসরকারি লাগবে কেন?
–উত্তর আগেই দিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশ কিউবার মত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র না যে সবকিছুই হবে রাষ্ট্রায়ত্ত , আবার কানাডার মত কল্যাণ রাষ্ট্রও না, যে সব চাহিদা মেটানোর দায় নিয়ে বসে থাকবে। বেশিরভাগ দেশের মতই বাংলাদেশ সীমিত আয়ের দেশ। তাই একদিকে অপর্যাপ্ত সরকারী সামর্থ্য , সেইসাথে এই খাতে পুঁজি খাটালে বিনিয়োগকারীদের লাভের আশা আর মানুষের কিছুটা পয়সা খরচ করে হলেও আরেকটু ভাল সেবা পাওয়ার আশা এইসব মিলেই বেসরকারি হাসপাতালের জন্ম। বাংলাদেশের মত বিপুল জনসংখ্যার দেশে সরকার কখনোই জনগণের পুরো চিকিৎসার খরচের দায়িত্ব নিতে পারবে না। তাই বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এখানে সাপ্লিমেন্ট করতেই হবে।

**বেসরকারি হাসপাতাল হল গলাকাটা ডাকাত , খালি লাভের ধান্দা
–কথাটা আংশিক সত্য। একজন বিনিয়োগকারী যখন পুঁজি খাটাবেন তখন তিনি লাভের চিন্তা করবেন এটাই স্বাভাবিক। একটা হাসপাতাল যে কী বিপুল বিনিয়োগ ও মেইনটেন্যান্স প্রয়োজন হয় সেটা অধিকাংশ সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে । তবে সব বেসরকারি হাসপাতাল ই যে লাভের জন্য তা কিন্তু না। অনেক অলাভজনক হাসপাতাল ও আছে। আমাদের বাংলাদেশেই বারডেম এর সাধারণ ওয়ার্ডে থাকলে আপনার খরচ যে কোন সরকারী হাসপাতালের পেয়িং বেডের কাছাকাছি ই হবে।

** ভারতে কম খরচে কী সুন্দর হাসপাতাল-সিএমসি ভেলোর, টাটা মেমোরিয়াল মুম্বাই; আমাদের শালারা কসাই
–এইবার আসল যায়গায় হাত দিয়েছেন। একটা তিতা সত্য আগেই বলে নেই- আপনি যেসব হাসপাতালের সাথে তুলনা দিবেন তারা কেউ ই কিন্তু সরকারী না, সিএমসি মিশনারিদের মাধ্যমে পরিচালিত আর টাটা হাসপাতালের একটা অংশ ভারতীয় আণবিক সংস্থা এর অধীন। তো এসব হাসপাতাল কিভাবে এত সহনীয় খরচে এতকিছু দেয়?? হিসাব খুব সোজা- ভর্তুকি আর অনুদান। এসব হাসপাতাল কী পরিমাণ অনুদান পায় তা নিয়ে আপনার কোন ধারণাই নেই। খালি এক টাটা গ্রুপের কাছ থেকেই মুম্বাই টাটা যে অনুদান পায় তা শুনলে পিলে চমকে উঠবে। টাটা বা ভেলোর এর ওয়েবসাইটে যান- সেখানে ডোনেট করারা জন্য আলাদা ট্যাব আছে। ‘ফ্রেন্ডস অফ ভেলোর” নামে আলাদা গ্রুপ ই আছে ফান্ড রেইজ করার জন্য। এতে লাভ দুই পক্ষের ই, মানুষ কম খচে সেবা পেল – আর দাতারা পেল বিশাল ট্যাক্স মাফ। বিশ্বাস না হলে ওদের ওয়েবসাইটে যান, কিভাবে কোন একাউন্টে দিলে ট্যাক্স মাফ হবে সুন্দর বোঝানো আছে । বাংলাদেশে বারডেম, ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল, আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল এই মডেলে এগোবার চেষ্টা করছে। তাদের জন্য সাধুবাদ।

**প্রাইভেটে তো সকালে ভাল ডাক্তার নাই, সব ভালো সরকারী ডাক্তার তো বিকালে
–এটা আমাদের বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আরেকটা নগ্ন সত্য। দু চারটা বড় কর্পোরেট বাদে কারোই সার্বক্ষণিক স্পেশালিষ্ট নেই। কেন নেই? কারণ এতে খরচ আছে। স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা তো চাইবেন ই কম তেলে মুচমুচে ভাজা। তাই পরিপূর্ণ হায়ারার্কি বাদ দিয়ে বিকেলে চেম্বার করা স্পেশালিষ্ট অথবা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক স্যারদের দিয়ে পসার জমিয়ে তোলার দিকে তাদের চোখ। কারণ পুরো সিস্টেম আদর্শভাবে গড়ে তোলায় খরচ অনেক, লাভ কম । নামকাওয়াস্তে কিছু মেডিকেল অফিসার আর জাঁদরেল প্রফেসর স্যারদের মাঝখানের দুই তিনটা লেভেল প্রায় নেই বললেই চলে। তাই বেসরকারি সিস্টেমেরও মাজায় জোর থাকেনা কাজের সময়।

** ভালো ডাক্তার গড়ায় বেসরকারি সেক্টরের অবদান কী?
–প্রায় “শূন্য”। ডাক্তারি পাস করাতে প্রাইভেট হাসপাতালগুলো যেমন উদগ্রীব, কিন্তু পাস করানোর পর তাদের দায়িত্ব নিতে ততটাই উদাসীন । এক নামকরা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের টপ লেভেলের একজন গর্ব করে বলেছিলেন- তারা ডিএমসি আর এসএসএমসি ছাড়া কাউকে চাকরি দেন না। নিজের মেডিকেল থেকে পাস করাদের উপর তার আস্থা নেই কেন এটা জিজ্ঞেস করাতে উনি অবশ্য কোন উত্তর দেননি। তারা পাস করাবেন কিন্তু দায়িত্ব নেবেন না। এমবিবিএস থেকে বিশেষজ্ঞ হওয়ার যে ৮-১০ বছরের সংগ্রাম সেই পথে তাদের আর খবর নেই। সবচাইতে বড় জিনিস হল দু একটা কর্পোরেট হাসপাতাল বাদে জুনিয়র ডাক্তারদের চাকরির নিশ্চয়তা, বোনাস, প্রভিডেন্ট , গ্রাচুইটি কিছু নেই। ঢাকার নামকরা হাসপাতালে সিনিয়র মেডিকেল অফিসারদের বেতন বেশি বেড়ে গেছে ইনক্রিমেন্ট পেতে পেতে, তাই তাদের বাদ দিয়ে কম বেতনে ফ্রেশার নেবার ইতিহাস ও খুব বিরল নয়। দশ বছর চাকরির পরে এক চিঠিতে তারা আপনাকে শূন্য হাতে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে কিচ্ছুটি করার নেই। করোনা পরিস্থিতিতে কয়েকটি বড় হাসপাতালে অর্ধেক বেতন বা অঘোষিত ছাঁটাই এর পর আশা করি এটা নিয়ে বেশি কিছু বলার দরকার পড়ে না ।
অথচ ভারতে বেশিরভাগ বড় বেসরকারি ইন্সটিটিউটেই পোস্ট গ্রাজুয়েশন ট্রেনিং, প্রমোশন সব হয়। তাই সরকারী চাকুরীর জন্য তাদের অতটা হাহাকার নেই।

বাংলাদেশেও ব্যতিক্রম আছে- বারডেম, ঢাকা শিশু হাসপাতাল , বাংলাদেশ মেডিকেল সহ কয়েকটা বেসরকারি মেডিকেল কলেজেই পরিপূর্ণ ট্রেনিং কাউন্ট করার ব্যবস্থা তারা করেছে। কয়েকটাতে এমডি, এম এস কোর্স ও খোলা সম্ভব হয়েছে। ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু বিষয়ে ডিপ্লোমা করার জন্য দুই বছর পুরো বেতনে শিক্ষাছুটি দিচ্ছে – কিন্তু বাকিরা কি করছে? ঢাকার বাইরে সারা বাংলাদেশ কিভাবে চলছে? সেই প্রশ্ন ওঠা কি খুব অবান্তর?

**তাহলে উপায়???
–বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছাড়া আমাদের জনগণের চাহিদা মেটানো যেমন সম্ভব না তা যেমন সত্য তেমনি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা জনগণের সাধ্যের বাইরে চলে গেলেও মুশকিল। তাই বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বিকশিত হতে দিতে হবে নিজেদের প্রয়োজনেই , কিন্তু নিয়মতান্ত্রিকভাবে। মানহীন ছাপরা হাসপাতাল যেমন বন্ধ করতে হবে তেমনি সিএমসি বা টাটা মডেলে বড় বড় কর্পোরেটদের আসতে প্রয়োজনে বাধ্য করতে হবে। কর্পোরেট সোশ্যাল লায়াবিলিটি বলে একটা টার্ম আছে। এর আওতায় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাস্থ্যখাতে সাবসিডি দিতে প্রয়োজনে বাধ্য করাতে হবে। এই খাতে ডোনেশনে হয়রানিমুলকভাবে ট্যাক্স রিবেট পাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে পারলে তারাও উৎসাহী হবে।
আর সবচাইতে বড় বিষয় হল হাসপাতালগুলোকে ধার করা বিশেষজ্ঞ সিস্টেম থেকে বেরিয়ে ফুল টাইম প্রয়োজনীয় ডাক্তার ও অন্যান্য সাপোর্টিং স্টাফ নিশ্চিত করাতে হবে । এই একটা জিনিস করা গেলেই তখন তাদের প্রয়োজনেই তারা সিস্টেমকে ঠিক করে নিবে।

**সরকারি ফ্রি সিস্টেম কি বুমেরাং ??
–না, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এখনো এটাই সত্য যে স্বাস্থ্যের জন্য আমাদের আলাদা কোন বাজেট নেই। একটু ছোট উদাহরণ দেই- আমাদের সব মধ্যবিত্ত পরিবারে চাল , ডাল , আলু, এমনি পান সিগারেটের বাজেট থাকে। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হলে যে হাজার পাঁচেক টাকা লাগতে পারে এই বাজেট তা থাকে না, আমার নিজের ও নেই। তাই আচমকা অসুস্থ হলে হাসপাতালে খরচ মিটিয়ে চাল কেনার পয়সায় টান পড়ে। এটাই আসলে কসাই আর গলাকাটা উপাধির পেছনের মূল কারণ। তাই ১০ টাকার টিকেট আর ১৫ টাকার ভর্তি এখনো প্রাসঙ্গিক।

কিন্তু সমস্যা হয়েছে মানুষের সাধ্য কিছুটা বাড়ায়, আর চটকদার বিজ্ঞাপনে । আমরা এখন খালি চিকিৎসা চাই না, সাথে সার্ভিস চাই। এখানেই সরকারী সিস্টেমের সীমাবদ্ধতা। আমার এপোলোর লাখ টাকা বিল দেওয়ার সামর্থ্য হয়ত নেই কিন্তু কিছু দিতে পারব ; আমি ১০০ টাকায় টিকেট কাটতে রাজি কিন্তু চাই প্রফেসর স্যার আমাকেই ১০ মিনিট ধরে দেখুন । আমি ভর্তির জন্য ১৫ টাকার যায়গায় ১৫০০ দিতে পারব কিন্তু বেডটা যেন একটু আরামের হয়, ডায়েটের খাবারটা একটু যেন হয় ভাল… এই ক্ষেত্রে সরকারী সিস্টেমের কিছুটা সীমাবদ্ধতা।

এই যায়গাটাতেই আমাদের বেসরকারি সিস্টেমের বিকশিত হওয়ার সুযোগ। ইচ্ছা , স্বচ্ছতা থাকলে আর রাতারাতি বড়লোক হওয়ার ধান্দা না থাকলে এটা যে সম্ভব সেটার জন্য বারডেম, হার্ট ফাউন্ডেশনের মত উদাহরণ খুঁজতে দেশের বাইরে যাওয়া লাগে না। সরকারের কিছুটা সাবসিডি আর কিছু বেসরকারি ডোনেশনে এমন সিস্টেম ভালোভাবেই চলে তা আমাদের দেশেই প্রমাণিত।

একটু চাইলেই সম্ভব, একটু ইচ্ছা থাকলেই বাংলাদেশের প্রতিটা জেলায় এরকম মাল্টিডিসিপ্লিনারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। এতে সরকারীতে যেমন অযথা চাপ কমবে, তেমনি কম খরচে মানসম্মত সেবা পাবে জনগণ। আখেরে লাভ হবে দেশেরই।

Exit mobile version