Site icon Jamuna Television

আনোয়ার উল আলম শহীদ : সফলতার প্রতিচ্ছবি


সবুজ মাহমুদ:

মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি স্বাধীনচেতা মানুষের কাছে একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায়। পৃথিবীর বহুদেশ তাদের বীরত্বের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আমরাও দীর্ঘ ন’মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশ পেয়েছি। তবে এ বিজয় ৩০ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে। যাদের অবদানে আজ আমরা বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি তাদের অন্যতম একজন আনোয়ার উল আলম শহীদ। যিনি স্বদেশভূমি এবং দেশমাতৃকার দুঃখমোচনে নানা সংগ্রাম আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন এবং সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রামকে আজীবন অনুধ্যানের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বিষয়টি জীবনমুখি শৈল্পিক আন্দোলন হওয়ায় তার প্রতিটি লেখা, বক্তব্য ও কর্মের জগৎ একটি সুশৃঙ্খল চিরায়ত শিল্প হিসেবে ব্যক্ত হয়েছে।

কর্মজীবনে আনোয়ার উল আলম শহীদ জাতীয় রক্ষীবাহিনীর উপ-পরিচালক, কর্নেল, সচিব ও রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও মননশীল লেখক পরিচয়ে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন এবং পরিচিতও। আনোয়ার উল আলমের মেধা, সংযত আচরণ, সাহস, সততা ও জীবনের প্রতি গভীর মমত্ববোধ তার স্বাধীনতাযুদ্ধের আন্দোলনকে আরো গতিময়তা দিয়েছে। ফলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আপন নেতৃত্বগুণে অধিকার করেন বিশেষ স্থান। টাঙ্গাইলের ছোট ছোট মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোকে পুনর্গঠিত করেন পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের গঠনমূলক কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে মধুপুর মহানন্দপুর মুক্তাঞ্চলে ‘টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী’ নামে সুদৃঢ় প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।

মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তী নায়ক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর অসীম সাহস আর চৌকস রণকৌশলে যা পরবর্তীতে ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ নামে অধিক পরিচিতি লাভ করে। আনোয়ার উল আলম শহীদ শুরু থেকে এ বাহিনীর বেসামরিক প্রধান এবং মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত এই দুই মাস সর্বাধিনায়কের গুরুদায়িত্বও পালন করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সফল সংগঠক হিসেবে যেমন মুজিবনগর সরকারের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে বহুমাত্রিক কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তেমনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। এ কারণে টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা অপরিসীম।

২.
আমাদের সমাজ, সভ্যতা, শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, অনেক প্রাজ্ঞজনের জীবনব্যাপী অবদানে সমৃদ্ধ। কিন্তু তারা মহীরূহরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েও সস্তা জনপ্রিয়তা বা খ্যাতিলাভের উন্মাদনায় না মেতে চিরায়ত জীবনসত্য ও জীবনতৃষ্ণার প্রেরণায় স্বদেশের জন্য সংগোপনে কাজ করেছেন। এ কারণে তারা সমাজে প্রচারবিমুখ। আনোয়ার উল আলম- এর উপর প্রকাশিত ছোটকাগজের কাজ করতে গিয়ে তার সাথে আমার সম্পর্কের ভিতটা আরো মজবুত হয়। তিনিও নানা বিষয়আশয় নিয়ে আড্ডা দেয়ার জন্য টাঙ্গাইলে আসা শুরু করেন। বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়সহ শহরের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রদের সাথে তার দারুণ সখ্য গড়ে ওঠে। শহীদ তাদের জীবনের স্বপ্নের কথা শুনতে খুব পছন্দ করতেন। তবে কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রাম, বীরত্ব ও আত্মদানের সঠিক ইতিহাসের দুর্লভ তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইতো তাহলে তিনি বেশি খুশি হতেন। কিশোর কিশোরীদের নিয়ে এমন সুখকর সময় পার করার অভ্যেসটা তার ষাটের দশক থেকে শুরু হয়েছিল। আনোয়ার উল আলম শহীদ কিশোরকালেই নানা সাহিত্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬১ সালে ‘জাগরি কচি-কাঁচার মেলা’ গঠন, ১৯৬৩ সালে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাস ‘বিষাদসিন্ধু’খ্যাত মীর মোশাররফ হোসেন সম্পাদিত পাক্ষিক ‘হিতকরি’র ‘কিশোর প্রাঙ্গন’-এর পরিচালক এবং ১৯৬৪ সালে জাগরি কচি-কাঁচার মেলা’র আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এছাড়া ‘জাগরি’, ‘সূর্যের গান’, ‘আয়না’ ইত্যাদি ম্যাগাজিন সম্পাদনাসহ ১৯৭১ সালে ‘রণদূত’ ছদ্মনামে সাপ্তাহিক ‘রণাঙ্গন’ সম্পাদনা করেন। এতসব শিশুকিশোর সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার কারণে ৭৩ বছর বয়সেও তার মনটা রয়ে গেছে তরুণ ও সতেজ।

শিশুকিশোরদের সাথে সময় কাটাতে তিনি আনন্দবোধ করতেন। আড্ডায় কেউ না আসলে ক্ষুদেবার্তা পাঠাতেন। ২০১৯-এর কোন একদিন আমাকেও একটি বার্তা লিখেন ‘আমি এখন টাঙ্গাইলে, চলে আসো। জরুরি কথা আছে।’ আমি গেলে তিনি বললেন, ‘আমাদের বিবাহোত্তর জীবনটা চারদশক পেরিয়ে গেছে, অথচ তোমার ভাবিকে (ডা. সাঈদা খানকে) তেমন কিছুই দিতে পারিনি। দুঃসময়ে সে পরিবারটাকে সামলে নিয়ে আজকের পরিপাটি সংসারে রূপ দিয়েছে। ‘ডা. সাঈদা খান: একজন সফল মানুষের কথা’ শিরোনামে তুমি একটি জীবনীগ্রন্থ লিখবে। তার জীবনের অনেক সফলতা গল্প আছে। যিনি দেশের বাইরে থেকেও স্বদেশিদের জন্য নানা কার্যক্রমে সদা ব্যস্ত থাকতেন। তথ্য সব আমি দেবো। ২০২০-এ তার জন্মদিনে বইটি উপহার দেবো। তবে কথাটি গোপন রাখবে। তোমার ভাবিকেও (ডা. সাঈদা খানকে) জানাবে না।’ আমি কথামতো তথ্য নিয়ে কাজ শুরু করলাম। লেখাও প্রায় শেষ। কিন্তু করোনার মহামারিতে তা আর প্রকাশ করা সম্ভব হলো না। জন্মদিনের অনুষ্ঠানও হলো না। অথচ, গত ১০ ডিসেম্বর আনোয়ার উল আলম শহীদ তার স্বপ্নটিকে বাস্তবায়ন না করেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আর কোনদিন তিনি অন্য কোন কাজ নিয়ে আমাকে ডাকবেন না। ‘আমি শহীদকে হতে দেখেছি’ বঙ্গবন্ধুর এই কথাটি আজ খুব মনে পড়ছে। শহীদ হয়েছেনও। এতো এতো সফলতার অধিকারি ক’জনের ভাগ্যেইবা জোটে? অনেক গুণীব্যক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার কাছে আমি, আমরা- সবাই ঋণী। প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার কাছেই দেশ এবং জাতি ঋণী। আনোয়ার উল আলম শহীদের অসমাপ্ত স্বপ্নের বইটি হয়তো একদিন প্রকাশ হবে, বছর ঘুরে ভাবির জন্মদিনও আসবে। কিন্তু এতসব কিছুর আয়োজককে আমরা আর কখনো পাবো না। তার এই অপূর্ব ভালবাসার নিদর্শন ডা. সাঈদা ভাবিকে আরো অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখবে, আশা করি।

লেখক : সম্পাদক, চতুর্মাসিক যমুনা।

Exit mobile version