উইঘুরদের জন্য তৈরি ‘রি-এডুকেশন’ ক্যাম্পে মুসলিম নারীদের নিয়মিত ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতন করাই চীনের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি ও পুলিশ সদস্যদের কাজ। বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিবিসিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমনটা জানান ক্যাম্পে বন্দি থাকা নারী তুরসুনায়ে জিয়াউদুন।
জিয়াউদুন বলেন, করোনা মহামারির আগে থেকেই নারীদের ধর্ষণ ও নির্যাতন করতে আসা প্রত্যেক পুরুষই মুখোশ পরিহিত অবস্থায় থাকতো। তারা বেশ পরিপাটি অবস্থায় থাকতো কিন্তু সেটি পুলিশের ইউনিফর্ম ছিল না।
তিনি জানান, মধ্যরাতে তারা নারীদের কক্ষগুলোর কাছে আসতো এবং নিজেদের পছন্দমতো নারীদের নিয়ে একটি অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করতো। সে কক্ষে নজরদারি ক্যামেরা থাকতো না। অনেক রাত তারা আমাকে নিয়ে সে কক্ষে প্রবেশ করেছে। তিনি বলেন, এগুলো স্মৃতি আমার জন্য প্রচণ্ড ভীতিকর, আমি এগুলো কখনো ভুলতে পারবো না। এমনকি তারা কী কী করেছে তা আমি মুখেও উচ্চারণ করতে পারবো না।
জিনজিয়াং-এ অবস্থিত একটি ক্যাম্পে তাকে নয় মাস আটক রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে জানা যায়, চীনে ১০ লক্ষেরও বেশি উইঘুর মুসলিম নারী ও পুরুষকে এসব ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। যদিও চীন এগুলোকে তাদের জন্য সেক্যুলারিজম সংক্রান্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ব্যবহার করে।
মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্থা চীনের এসব ক্যাম্পের বিরুদ্ধে উইঘুর মুসলিমদের ওপর যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, নজরদারি, তাদের উপর নির্যাতন করা, উইঘুরদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা ও জোরপূর্বক নানা কাজে বাধ্য করার অভিযোগ আনে। কিন্তু এর আগে বিভিন্ন সময় এসব ক্যাম্পে বন্দি থাকা ব্যক্তিরা ও ক্যাম্পের প্রহরীরা এসব সত্য বলে বিবিসিকে জানিয়েছে।
২০১৪ সালে উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলার দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উইঘুর সফরে যান এবং এইসব নীতি বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দেন। নিউইয়র্ক টাইমস এর এক প্রতিবেদনে প্রমাণ দেখানো হয় যে, জিনপিং উইঘুরদের উপর নৃশংসভাবে নির্যাতন করার নির্দেশ দেন। একইসাথে তাদের উপর গণহত্যা চালানোর আদেশ দেন। কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ ও তথ্যপ্রমাণ অস্বীকার করেছে।
তুরসুনায়ে জিয়াউদুন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। জিয়াউদুন জানান, প্রতিরাতেই মহিলাদের তাদের কক্ষ থেকে বের করে আনা হতো এবং মুখোশ পরিহিত চীনা ব্যক্তিরা তাদের ধর্ষণ করতো। এমনকি তিনবার জিয়াউদুন এসব ব্যক্তিদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতন ও গণধর্ষণের শিকার হন। প্রতিবারই দুই অথবা তিন জন লোক তাকে নির্যাতনে অংশ নিত।
জিয়াউদুন এর আগে কাজাখাস্তান থাকাকালীন গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেছেন। তবে তিনি তার সাথে ঘটা সব ঘটনা বলতে পারেননি, কারণ তার ভয় ছিল ক্যাম্পে তার সাথে যা হয়েছে এবং যেসব ঘটনা তিনি দেখেছেন তা তিনি প্রকাশ করলে তাকে পুনরায় জিনজিয়াং-এ ফেরত পাঠানো হবে। এর ফলে তাকে আগের চেয়ে আরও ভয়াবহ মাত্রার নির্যাতন সহ্য করতে হবে। একইসাথে তিনি তার সাথে ঘটা ঘটনার বর্ণনা করতে লজ্জিতও ছিলেন।
তবে চীনের কঠোর নিরাপত্তা ও নানা বাধার কারণে জিয়াউদুনের এসব বক্তব্যের প্রমাণ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে বিবিসি। কিন্তু বিবিসি জিয়াউদুনের ভ্রমণ নথি ও ইমিগ্রেশন নথি সংগ্রহ করতে পেরেছে। জিয়াউদুন জিনজিয়াং-এ যে ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন বলে বর্ণনা করেছেন তার স্যাটেলাইট ইমেজ এর আগে প্রকাশিত বন্দিশালার সাথে মিলে যায় এবং ইতিপূর্বে এসব ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়া ব্যক্তিদের বর্ণনার সাথেও জিয়াউদুনের ওপর ঘটা নির্যাতনের বর্ণনা মিলে যায় বলে বিবিসি জানিয়েছে।
জিনজিয়াং-এ চীনের নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আদ্রিয়ান জেনস কর্তৃক বিবিসিকে সরবরাহকৃত ২০১৭-১৮ সালের কুনেস কাউন্টি বিচার ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ নথিপত্র ঘেটে দেখা যায় উইঘুরদের জন্য সেখানে শিক্ষার মাধ্যমে পরিবর্তন করার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে শিক্ষাকে বর্ণনা করা হয়েছে মগজধোলাই, অন্তর পরিষ্কার করা, মন্দচিন্তা দূরীকরণ ও ধার্মিকতা জোরদার করা।
জিয়াউদুন তাকে এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পরের অভিজ্ঞতা জানান। তিনি জানান, প্রহরীরা এক নারীকে লম্বা পোষাক পরার কারণে ধমক দিতে থাকে। কারণ এর মাধ্যমে তার ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ হয়। জিয়াউদুন বলেন, তারা ওই নারীর অন্তর্বাস ব্যতীত প্রতিটি জামা কাপড় খুলে নেয়। এসময় ওই নারী তার হাত দিয়ে তার শরীর ঢাকতে চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
তিনি বলেন, এই ঘটনা দেখার পর আমি প্রচণ্ড কাঁদতে শুরু করি। এমনি সেও (ভুক্তভোগী নারী) বৃষ্টির মতো কান্না করতে থাকে।
বিবিসি গুলজিরা আওল খান নামক একজন কাজাখ নারীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে যে জিনজিয়াং-এ ১৮ মাস বন্দী অবস্থায় ছিল। ওই নারীর দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী সে উইঘুর নারীদের চীনা পুরুষদের কক্ষে একা ছেড়ে আসার আগে ওইসব নারীদের নগ্ন করা ও তাদের হাতে হাতকড়া বাঁধার কাজে নিয়োজিত ছিল। চীনা পুরুষরা ওই নারীর উপর নির্যাতন ও ধর্ষণ শেষ করে বের হয়ে যাওয়ার পর ঘটনাস্থল পরিষ্কার করা ভুক্তভোগীকে গোসল করানোর দায়িত্বও ছিল তার কাঁধে।
আওল খান বলেন, আমার দায়িত্ব ছিল তাদের কাপড় খুলে নগ্ন করা ও তাদের হাতে হাতকড়া পরানো যাতে তারা নড়াচড়া না করতে পারে। হাতগুলো তাদের মাথার পিছনের বেধে দেয়া হতো। তারপর আমি সে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতাম ও একজন পুরুষ সে কক্ষে প্রবেশ করতো। এসব পুরুষরা কখনো পুলিশ কখনো অন্যকোন চীনা পুরুষও হতো। আমি নিশ্চুপভাবে রুমের দরজার পাশে অপেক্ষা করতাম। তারা বের হয়ে গেলে আমি সেই নারীকে গোসল করাতে নিয়ে যেতাম।
তিনি আরও জানান, ওইসব চীনা লোকরা সবচেয়ে সুন্দরী ও অল্পবয়স্ক নারীকে বেছে নেয়ার জন্য তাকে অর্থও প্রদান করতো।
আওল খান জানান, কিছু বন্দী সেখানকার প্রহরীদের এসব কাজে সাহায্য করতে বাধ্য ছিল, নয়তো তাদের ওপর আরও নির্যাতন করা হতো। আমি এইসব ক্ষেত্রে ক্ষমতাহীন ও অসহায় ছিলাম।’ সেখানে ধর্ষণ করাটাকে একটি নিয়ম হিসেবে গণ্য করা হয়? বিবিসির এমন প্রশ্নের জবাবে আওল খান বলেন, ‘হ্যা, ধর্ষণ’
তিনি বলেন, তারা আমাকে সে কক্ষে যেতে বাধ্য করে, তারপর ওইসব নারীদের কাপড় খুলে নিতে এবং তাদের হাত বাধাতে বাধ্য করে। তারপর আমাকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলে। কিছু মহিলাকে রাতে কক্ষ থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো এবং তারা আর কখনোই ফিরে আসতো না। আর যারা ফিরে আসতো তাদের হুমকি দেয়া হতো যাতে তারা তাদের সাথে কী ঘটেছে তার কিছু না প্রকাশ করে।
আওল বলেন, আপনি বলতে পারবেন না কী ঘটেছে, আপনি শুধুমাত্র নিশ্চুপ হয়ে যেতে পারেন। এটা করা হয়েছে প্রত্যেকের মধ্যকার শক্তিকে ধ্বংস করে দিতে।
ক্যাম্পে কাজ করতে বাধ্য হওয়া আরেক নারী সায়রাগুল সৌইতবায়ে বিবিসিকে বলেন, ধর্ষণ সেখানে একটি নিয়মিত ব্যাপার। সেখানকার প্রহরীরা তাদের পছন্দমতো নারীদের তুলে নিয়ে যায়।
এ সময় সায়রাগুল একটি গণধর্ষণের ভায়াবহ অভিজ্ঞাতার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বলেন, ২০ থেকে ২১ বছর বয়সী এক নারীকে প্রায় ১০০ জন বন্দির সামনে আনা হয় এবং তাকে মিথ্যা সাক্ষী দিতে বাধ্য করা হয়। তারপর পুলিশ সদস্যরা তাকে উপস্থিত সবার সামনে ধর্ষণ করে। এমনকি এই ঘটনার সময় উপস্থিত যারা প্রতিবাদ করেছে, চোখবন্ধ রেখেছে এবং অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল তাদেরও শাস্তির জন্য নিয়ে গেছে তারা।
সায়রাগুল বলেন, আমার মনে হচ্ছিল আমি মারা যাচ্ছি, আমি তখন মৃত ছিলাম।
কালবিনুর সাদিক নামে এক উজবেন নারী যিনি এইসব ক্যাম্পে চাইনিজ ভাষার শিক্ষক ছিলেন তিনি জানান একবার তিনি ক্যাম্পের এক নারী প্রহরীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ক্যাম্পে নারীদের উপর ধর্ষণ ও নির্যাতনের যে গল্প শুনা যায় তা সত্য কিনা? তখন ওই প্রহরী তাকে দুপুরের খাবারের সময় একটি দুরবর্তী স্থানে নিয়ে ক্যাম্পের মুসলিম নারীদের ওপর চলা নির্যাতনের বর্ণনা দেন। ওই প্রহরী বলেন, ধর্ষণ করাটাই এখানে সংস্কৃতি এমনি গণধর্ষণও। চীনা পুলিশ সদস্যরা শুধু ধর্ষণই করে না বরং তাদের বৈদ্যুতিক শকও দেয়।
কালবিনুর জানান চার পদ্ধতিতে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। তা হলো- চেয়ারের মাধ্যমে, গোলকের মাধ্যমে, হেলমেটের মাধ্যমে ও পায়ুপথে বৈদ্যুতিক লাঠি প্রবেশ করিয়ে।
Leave a reply