Site icon Jamuna Television

‘সিনহা পানি চাইলে ওসি প্রদীপ বলেন, তোকে মেরেছি কি পানি দেয়ার জন্য?’

নিহত মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান ও বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রমের দ্বিতীয় দিন ছিল মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট)। এদিন, আদালতে সাক্ষ্য দেন ঘটনার সময় সিনহার সঙ্গী ও প্রত্যক্ষদর্শী সাহেদুল ইসলাম সিফাত। টানা তিনদিন চলবে এই সাক্ষ্যগ্রহণ। এর আগে, বিচার কার্যক্রমের প্রথম দিন সোমবার (২৩ আগস্ট) মামলার বাদী সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ারের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা অনুষ্ঠিত হয় ১নং দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে।

সিফাত তার সাক্ষ্যতে আদালতে বলেন, ২ তারিখ রাত ১২ টার দিকে কক্সবাজার পৌঁছে ওয়ার্ল্ড বিচ রিসোর্টে উঠি। সেখানে ৬/৭ তারিখ পর্যন্ত থেকে পরে নীলিমা রিসোর্টে উঠি। পরিকল্পনা অনুযায়ী পাহাড়, জঙ্গল, বিচ এলাকায় ভিডিও ধারণ ও স্থিরচিত্রের কাজ শুরু করি। এই কাজের সময় স্থানীয় লোকজনের সাথে যোগাযোগ হয়। স্থানীয় মানুষের কাছে জানতে পারি টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত মানুষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে অত্যাচার করছে এবং টাকা নিচ্ছে। এসব শোনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এইসব নিয়ে ভিডিও বানাবো, এর মাধ্যমে সরকার ও জনগণকে সচেতন করবো। কিছু মানুষের বক্তব্য রেকর্ড করি।

সিফাত তার সাক্ষ্যতে বলেন, জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে একদিন মেরিন ড্রাইভে আসামি লিয়াকত ও প্রদীপের সাথে দেখা হয়। তখন পূর্ব পরিচিত হিসেবে সিনহা মানুষের অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন প্রদীপকে। এসময় ওসি প্রদীপ মেজর সিনহার সাথে দুর্ব্যবহার করেন। প্রদীপ বলেন, অনেক সাংবাদিককে পিটিয়ে জেলে পাঠিয়েছি, আপনি এই এলাকা থেকে চলে যান, নয়তো আমি আপনাকে ধ্বংস করে দেব, কোনো মেজর-টেজরকে পাত্তা দেই না। এরপর আমরা নীলিমা রিসোর্টে ফেরত আসি।

ওই ঘটনার পর সিনহা আমাদের অভয় দেন। এরপর আমরা আমাদের কাজ করিতে থাকি। এরপর, ৩১/৭/২০ তারিখ বিকেল আনুমানিক ৩/৪ টার দিকে সিনহাসহ মারিশবুনিয়া এলাকায় যাই। এক জায়গায় গাড়ি পার্ক করে মইন্না পাহাড়ের দিকে যাত্রা করি।সেখানে একজন মসজিদের ইমামের সাথে সিনহার সালাম বিনিময় হয়। একটি ছোট ছেলে মইন্না পাহাড়ের রাস্তা দেখিয়ে দেয়। কাজ করতে করতে রাত আটটা-সাড়ে আটটা বেজে যায়। পাহাড় থেকে নামার পর তিনজন লোক আমাদের দিকে টর্চলাইট মারে, তাদেরকে কাছে আসতে বললে তারা না এসে নিজেরা কথা বলতে বলতে চলে যান। তখন পায়ে হেঁটে মেরিন ড্রাইভ পর্যন্ত যাই, তারপর গাড়িতে ওঠে রিসোর্টের দিকে যাত্রা শুরু করি।

সিফাত সাক্ষ্যতে আরও বলেন, যাওয়ার পথে প্রথমে বিজিবি চেকপোস্ট, সেখানে তারা স্যালুট দিয়ে ছেড়ে দেয়। পরে শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে গাড়ি থামতে ইশারা করে। এসময় কনস্টেবল রাজিব গাড়ির কাছে এসে পরিচয় জানতে চায়। তখন সিনহার নিজের পরিচয় দেন, তারাও স্যালুট করে যাবার জন্য ইশারা করেন। সে সময় পেছন থেকে থামাও থামাও বলে লিয়াকত দৌড়ে এসে পরিচয় জানতে চায়। এ সময় সিনহা আবারো নিজের পরিচয় দেন। তার পরিচয় পেয়ে গাড়ির সামনে গিয়ে বাম হাতে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়, ডান হাতে অস্ত্র আমাদের দিকে তাক করে থাকে। তখন নন্দদুলাল ড্রাম টেনে ব্যারিকেড দেয়।

এসময় লিয়াকত উত্তেজিত হয়ে গালিগালাজ করেন এবং গাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে বলেন। আমি (সিফাত) প্রথমে নামি, নামার পরপরই কনস্টেবল রাজিব ও এস আই শাহজাহান দুই হাত শক্ত করে ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে। লিয়াকত মেজর সিনহাকে গালিগালাজ করতে থাকেন, এসময় সিনহা কাম ডাউন (শান্ত হতে) বলতে বলতে গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে বের হয়ে আসেন এবং পরিচয় নিতে বলেন।

তারপর, সিনহা গাড়ির হেডলাইটের পাশে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দাঁড়ান। এসময় লিয়াকত শুট শুট বলে সিনহাকে লক্ষ‍্য করে দুই রাউন্ড গুলি করেন। সিনহা এসময় ঝুঁকে পড়লে লিয়াকত সামনে এগিয়ে এসে আরও দুই রাউন্ড গুলি করেন। সিনহা গুলি খেয়ে রাস্তার উপর পড়ে যান।

সিফাত আদালতকে বলেন, এরপর লিয়াকত নন্দদুলালকে নির্দেশ দেন সিনহাকে হাতকড়া পরাতে, একই সাথে এপিবিএন সদস্যদেরকে আমাকে হাতকড়া পরাতে নির্দেশ দেন। হাতকড়া না থাকায় পাশের বাজার থেকে রশি এনে আমাকে বাঁধেন। এরপর লিয়াকত বিভিন্ন জায়গায় ফোন দেয়া শুরু করেন, এক ফোনে বলেন টার্গেট ফেলে দিয়েছি। আরেক ফোনে বলেন, একটা ডাউন, আরেকটাকে ধরেছি। সিনহা পানি ও শ্বাস নিতে চাইলে লিয়াকত বলে, কুত্তার বাচ্চা, তোকে গুলি করেছি কি শ্বাস দেয়ার জন্য।

কিছুক্ষণ পরে টেকনাফের দিক থেকে দু’টি গাড়ি আসে, একটির ভেতর থেকে ওসি প্রদীপসহ ৫/৭ জন মানুষ নেমে আসেন। তারা লিয়াকত ও নন্দদুলালের সাথে কথা বলেন। পরে সিনহার কাছে এসে বলেন, অনেক টার্গেট করে তোকে মেরেছি। পা দিয়ে শরীর নাড়া দিলে সিনহা পানি চাইলে প্রদীপ বলে, তোকে মেরেছি কি পানি দেয়ার জন্য। এসময় জোরে জোরে তার পাঁজরে লাথি মারেন ও গলায় পা দিয়ে চেপে ধরেন। একপর্যায়ে সিনহা নিস্তেজ হয়ে পড়ে।

এরপর প্রদীপের নির্দেশ মতো নোয়া গাড়ি থেকে ইয়াবা-গাঁজা নিয়ে সিনহার গাড়ি থেকে সেগুলো পাওয়ার কথা জানায়। তখন প্রদীপ বলে, তোদের বলেছিলাম চলে যেতে তোরা যাসনি ভিডিও বানিয়েছিস সেগুলো কোথায়? আমি বলি, সেগুলো নীলিমা রিসোর্টে আছে।

পরে আমার হাতের দড়ি খুলে হাতকড়া পরিয়ে বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে নিয়ে যায় তারা। সেখানে নুরুল আমিন ও আয়াজের সাথে দেখা হয়, যারা পাহাড় থেকে নামার সময় আমাদের দিকে লাইট মেরেছিল।

মধ্যরাতে টেকনাফ থানায় নেয়া হয়, সেখান থেকে পরদিন প্রথমে পুলিশ সুপার, পরে আদালত হয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। আদালতে গিয়ে শিপ্রার সাথে দেখা হয়। পরবর্তীতে র‍্যাব তদন্ত করে ফাইনাল রিপোর্ট দিলে আমাকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

মঙ্গলবার সিনহা হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রমের দ্বিতীয় দিনে সিফাতের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়নি। আগামীকাল বুধবার তার সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে পুনরায় বিচার কাজ শুরু হবে।

উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই রাতে দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা রাশেদ খান। নানা ঘটনাপ্রবাহের পর সে বছরের ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাসসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব ১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খায়রুল ইসলাম।

Exit mobile version