মেয়ের জন্য অদম্য মায়ের ‘বাবা’ হয়ে ওঠার গল্প

|

ফারহিন ইস্তিহাক এবং তার মেয়ে রিদা জাহরা।

প্রেমিককে ভরসা করে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে গর্ভে সন্তান নিয়ে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলেন মনের মানুষের সঙ্গে। কিন্তু সেই মানুষই দূরে চলে যান আচমকা। সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগেই প্রসূতি ফারহিনকে ফেলে রেখে পালিয়ে যান প্রেমিক। ততদিনে পরিবারের সঙ্গে দূরত্বও অনেকটা বেড়ে গেছে ফারহিনের। কিন্তু পিছিয়ে আসেননি ফারহিন। ‘একলা মেয়ে’ থেকে ‘একলা মা’ হয়ে ওঠেন তিনি। জন্ম দেন ফুটফুটে কন্যা সন্তানের। কিন্তু সমাজ সহজে ছেড়ে দেয় না। তাই ‘পুরুষ’ সেজে ‘বাবা’ পরিচয়ে মেয়ে মানুষ করে চলেছেন লাহোরের ফারহিন ইস্তিহাক। খবর আনন্দবাজার পত্রিকার।

খবরে বলা হয়, ফারহিনের কথা প্রথম পৃথিবীকে জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের লেখক জাইন উল হাসান। একটি টুইট করে তিনি ছবিসহ জানিয়েছিলেন ফারহিনের কাহিনি। ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে তার টুইটার হ্যান্ডলে ‘পিনড’ (সবার উপরে) করে রাখা রয়েছে সেই কাহিনি। ফারহিনের তখন বয়স ছিল ৪১।

লাহোর শহরের আনারকলি বাজারে ছোট্ট একটি দোকান আছে ফারহিনের। প্রতিদিন পুরুষদের পোশাকেই তিনি দোকানে বসেন। সকলে তাকে পুরুষ হিসেবেই চেনে। ফারহিন জানিয়েছিলেন, মানুষের কৌতূহল আর অপছন্দের প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই ওই পথ নিয়েছেন তিনি। সমাজ যে ‘একলা মা’-দের সহজে মেনে নেয় না, তা বুঝতে পেরেই মা হয়েও সন্তানের ‘বাবা’ সেজে থাকার পথ বেছে নেন তিনি। ফারহিনের কাহিনি জানাজানি হওয়ার সময় তার কন্যা রিদা জাহরার বয়স ৯ বছর। লাহোরের একটি গার্লস হোস্টেলে থাকেন মা-মেয়ে। সেভাবে আর কোনো স্বজন নেই তাদের। ফারহিনের বাড়ি ছিল করাচিতে।

এক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে গেলে আপত্তি তোলে পরিবার। তখন তাদের অমতেই বিয়ে করবেন বলে ঠিক করেন। কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় অন্য দিকে। ফারহিনের কথায়, ২০১০ সালে বিয়ে করবো বলে ঠিক করি। যাকে ভালবাসতাম, সে আলাদা জাতের হওয়ায় বাড়ির কেউ মেনে নেননি। খুব চিন্তায় ছিলাম। কারও কোনো সাহায্য ছাড়াই হাসপাতালে ভর্তি হই। কিছু জটিলতাও ছিল। চিকিৎসকদের বলেছিলাম, আমার কিছু হয়ে গেলে আমার সন্তানকে যেন আমার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।

তারপর ফারহিনের কোলজুড়ে আসে কন্যাসন্তান। কিন্তু নতুন লড়াই শুরু হয় তার। ‘একলা মা’ হিসেবে সন্তান পালন করবেন বলে ঠিক করে নিলেও শুরুটা সহজ ছিল না। ফারহিনের কথায়,‘ঠিক করেছিলাম, মেয়েকে এমন ভাবে মানুষ করবো, যাতে অন্তত আমার চেয়ে ভালো জীবন পায়।’ করাচি থেকে সাড়ে ৮০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে পাঞ্জাব প্রদেশের মুলতান শহরে এক বান্ধবীর কাছে মেয়েকে রেখে আসেন ফারহিন। প্রথমে একটি রেস্তরাঁয় ওয়েটারের কাজ নেন ফারহিন। কিন্তু আবার নতুন সমস্যা তৈরি হয়। বছর দেড়েক পর বান্ধবী ফারহিনকে জানান, তার পক্ষে আর শিশুটির দেখভাল সম্ভব নয়। তখন একবার নিজের বাবা-মায়ের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন ফারহিন। বলেন, আমি চেয়েছিলাম, আমায় মেয়ে হিসেবে মেনে নিতে না পারলেও তাদের নাতনিকে কিছুদিন দেখবেন তারা। চার বছর মেয়ে ওখানে ছিল। ততদিনে আমি নিজেকে অনেকটাই গুছিয়ে নিই। পরে লাহোরে একটি গার্লস হোস্টেলের খোঁজ পাই, যেখানে মেয়েকে নিয়ে থাকা এবং কাজ দুইই করা যাবে। সেই থেকে লাহোরই আমার শহর।

নতুন শহরে ‘একলা মা’ হিসেবে থাকাটা যতটা সহজ মনে করেছিলেন ফারহিন, ততটাও মসৃণ হয়নি পথ। সেই সময়ের কথা জানিয়ে ফারহিন বলেছেন, আনারকলি বাজারের মতো একটা ব্যস্ত এলাকায় কোনো মহিলার পক্ষে একলা দোকান চালানো সহজ ছিল না। পাকিস্তানের মতো পুরুষশাসিত সমাজে মহিলাদের প্রকাশ্যে হেনস্থা করাটা খুবই সাধারণ বিষয়। নানা রকম কটূক্তি, শারীরিক হামলা, যৌন হেনস্থার শিকার হওয়ার ভয়। সেই সমস্যা থেকে বাঁচতেই ‘একলা মা’ নিজের বহিরঙ্গ বদলে ‘বাবা’ সাজতে শুরু করেন।

ফারহিন বলেছেন, আমি সবসময়ই একটু টমবয় প্রকৃতির। ব্যবসা চালানোর জন্য এটা আমার বেশ ভালো উপায় বলে মনে হয়েছিল। সমাজের ‘কুনজর’ থেকে বাঁচতে একটা ছদ্মনামও নিয়েছেন ফারহিন- ‘আলি’। অপরিচিতরা বুঝতে পারেন না ‘আলি’র আড়ালে আছেন একজন ‘মা’। একলা মা।

ইউএইচ/


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply