Site icon Jamuna Television

যারা বিনয়প্রেমি, এ বই শুধু তাদের নয়

শুভ আহমেদ:

১.
তখন আমি গল্প করছিলাম। সন্ধ্যার পরের সময় ঠিক। বড় একটি মিষ্টির বাক্সের মতো কিছু একটা আমার হাতে দিল অনয়। অনয় আমার কাকাতো ভাইয়ের ছেলে। ওকে আমি বেশ পছন্দ করি। আমি ওর মুখের দিক তাকাতেই, ও বললো, তোমার নাম জানতে চেয়ে একজন দিয়ে গেছে এই প্যাকেট। এরপর অনয় চলে গেলো।

আসলে সন্ধ্যায় আমি মায়ের সাথেই গল্প করি। অর্থাৎ, সন্ধ্যাটা কাটে মায়ের সঙ্গে গল্প করে। যখন তার নামাজ শেষ হয়। এই ধারা কবে থেকে শুরু হয়েছে বোধ করি মা কিংবা আমি কেউ-ই ঠিক ভাবে জানি না।
আমাদের গল্প হয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। যেমন- সমাজ, সাহিত্য, বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি আর থাকে সমাজের সচেতন মানুষজন নিয়ে নানান গল্প কথা। অবশ্য গত একটি বছরে নতুন যুক্ত হয়েছে কোভিড পরিস্থিতি। আমি হয়তো বর্তমান চিত্রগুলি বিশ্লেষণ করছি মা শুনছেন, আবার মা বলছেন- আমার ছেলেবেলা, মায়ের মেয়েবেলা। বিভিন্ন জীবন, আদি জীবন। এদেশে পূর্বে ঘটে যাওয়া যে ঘটনাগুলি আমি দেখিনি তা হয়তো শুনছি, গোগ্রাসে গিলছি এমন। এমনি করে গল্পটা আব্বা ফেরা অব্দি চলতে থাকে।

অনয় এই প্যাকেটটা দিয়ে গেল মায়ের সঙ্গে গল্পের মধ্যে। মা আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন- কী ওটা, বই?
-হুঁ
-কী বই?
আমি কাগজে মোড়ানো প্যাকেটটি ছিড়ে মাকে বললাম- ‘এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার।’
সম্ভবত তিনি বিনয়কে জানেন না বা এঁর নামটাও শোনেননি কখনও। মা তার মুখখানায় অই রকম ভঙ্গি করেই চুপ হয়ে বসে রইলেন।

২.
‘এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার’ হাতে পেয়েছি মাস খানেকের বেশি হবে। নান্দনিক প্রচ্ছদ আর সুদৃশ্য চিত্রে মোড়ানো। বেশ মোটা আকারের ভারি বই। বইয়ের পাতাগুলোও ভীষণ মজবুতভাবে বাঁধা। অল্প অল্প করে পড়ছি। অনেকেরই লেখা আছে বইটিতে। এর মাঝে অনেকেই আছেন বেশ নামজাদা লেখক। তবে বইয়ের সব লেখাই খুব উন্নত, মেদহীন এবং আবেগাক্রান্ত নয়। প্রতিটি লেখার লেখকই যার যার জায়গা থেকে আলাদা আলাদাভাবে লেখার সাপেক্ষে উল্লেখযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং দুর্লভ তথ্য দিয়েছেন বিনয়কে নিয়ে।

একটু আগে আমি অই যে বললাম, অল্প অল্প করে পড়ছি। যখন যেই লেখকের লেখাটার নামটা চোখে ধরছে তখনই আমিও ওকে ধরে নিচ্ছি পড়ায়।

এই যেমন গতকাল চোখে ধরেছিল ‘বাল্মীকির কবিতা’ শিরোনামের লেখাটি, মানে ‘বিনয় কথকতা’ পরিচ্ছদের প্রথম লেখা। ‘সাম্প্রতিককালের এক কবি’, ‘কবিতা বিষয়ক প্রস্তাব’, ‘বেদনার আলো’ এই বইয়ে আমার পড়া প্রথম তিনটি গদ্য। আমি এখানে কোনো লেখকের নাম উল্লেখ করছি না। এমন আরও বেশ কিছু লেখা পড়েছি শেষের এবং মাঝের দিকে। পড়েছি সম্পাদকীয়ও কিন্তু এ লেখার ব্যাপ্তিটা একটু বেশি হতে পারে ভেবে সকল লেখার কথা বলতে চাইছি না। আসলে প্রতিটি লেখায় কিছু না কিছু পাচ্ছি নতুন ভাবে ভাববার; এক কথায় চিন্তার খোরাক জোগাচ্ছে। হয়তো এমন করে আলো ফেলেনি কেউ এভাবে- বিনয়ের লেখা, বিনয়ের জীবন, বিনয়ের গণিত, বিনয়ের কলকাতা, বিনয়ের বাংলাদেশ, বিনয়ের হিন্দু হোস্টেল, বিনয়ের ঠাকুরনগরের বিনোদিনী কুঠি আর বিনয় মানসী গায়ত্রী চক্রবর্তীর ওপর। এ সমস্ত কিছু যেন এক বইয়ের মলাটে বন্দি করে রেখেছেন- গ্রন্থ সম্পাদক।

৩.
আমার মনে হয় সমগ্র বিনয়কেই এক সঙ্গে আবদ্ধ অথবা তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন বইটির সম্পাদক এহসান হায়দার এবং স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তী। এবং তা তারা পেরেছেনও বোধ করি। একজন বিনয়কে নিয়ে এমন আশ্চর্য ফুল এর আগে কেউ সাজিয়েছে কিনা আমার তা জানা নেই। সাজালেও বিনয়ের উজ্জ্বল মাছের মতো আশ্চর্য ফুল এমন উজ্জ্বল হয়েছে কিনা তাও নিতান্তই প্রশ্নের বিষয়। সচেতন পাঠক এবং সমালোচকের সুদৃষ্টির কতটা পাবে এ বই এবং সম্পাদকগণ সেটা সত্যি দেখবার বিষয়। কেননা- মিডিয়া মোড়লদের বাদ রেখে সাজানো হয়েছে এই বইয়ের লেখকসূচি, যা স্বাভাবিকভাবে চক্ষুশূল হতে পারে।

সুদীর্ঘ পথপরিক্রমার পর এমন একটি সুপরিকল্পিত বই পাঠকের সমুখে আনা সম্ভব নিরন্তর পরিশ্রম করলেই, পরিশ্রম যে করেছেন সম্পাদক এহসান তা বোঝা যায়। আর দূর থেকে মঙ্গলবার্তার মতো আলো জ্বেলে রাখা আরেক সম্পাদকও ছিলেন এর সঙ্গে জড়িয়ে। সুতরাং ভালো কিছু হওয়াটাই আসল কাজ এটি পরিষ্কার প্রমাণ পেলাম এই বইয়ের মধ্যে দিয়ে। ৮২৪ পৃষ্টার এমন একটি গ্রন্থ প্রণেতা দুই তরুণ সম্পাদক এহসান হায়দার ও স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তীর জন্য শুভকামনা। আরও একটি তথ্য দিই গ্রন্থটির লেখক তালিকা কেবল সুচিন্তিত নয়, সুনির্বাচিতও বটে; যাঁরা এ গ্রন্থের সূচিতে আছেন লেখক হিসেবে, তারা হলেন- জ্যোতির্ময় দত্ত, মিনাক্ষী দত্ত, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, বেলাল চৌধুরী, আহমদ ছফা, মৃদুল দাশগুপ্ত, নুরুল আলম আতিক, তানভীর মোকাম্মেল, জহরসেন মজুমদার, জয় গোস্বামী, সুজিত সরকার, আর্যনীল মুখোপাধ্যায়, সব্যসাচী সান্যাল, শ্রীতরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবারতি মিত্র, মণিশংকর বিশ্বাস, ইমরুল হাসান, রিফাত চৌধুরী, অমিতাভ পাল, রাদ আহমদ-সহ দুই বাংলার নবীন-প্রবীণ কবি, অধ্যাপক, বিশ্লেষকগণ।

এমন পক্ষপাতহীন, সুপরিকল্পত, সুম্পাদিত গ্রন্থ করবার জন্য আগে জানতাম বয়স-টয়স লাগে- ওরেহ্ চুলে পাক ধরতে হয়; কিন্তু এখন দেখছি উল্টো। আমার মনে হয়েছে- বোঝাপড়া থাকতে হয়, নিবেদন থাকতে হয়। নাহলে বিনয়কে নিয়ে কলকাতার অতো বড় বড় চুলে পাক ধরা মহাজনী সাহিত্যের নাও, ইঞ্জিন চালিত নৌকা থাকতেও শেষমেশ বাংলাদেশ থেকে বের হলো এ বই! তবুও ভালো হলো তো প্রকাশ্য এ আকালেও কবিতা পড়ে লোকে…

গ্রন্থ পরিচিতি
এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার
সম্পাদনা: এহসান হায়দার, স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তী
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
প্রকাশনা: আশ্রয় প্রকাশন, ঢাকা
দাম: ১৪৫০ টাকা
প্রকাশকাল: ২০২১

Exit mobile version