Site icon Jamuna Television

রহস্যময় আগুনে পুড়ছে গ্রাম, আতঙ্কে এলাকাবাসী

বরগুনা প্রতিনিধি :

খালের পাড় ধরে বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া গ্রাম। গত একমাস ধরে রহস্যময় আগুনে পুড়ছে গ্রামের বাসিন্দাদের ঘরের আসবাবপত্র ও পোশাক। এমনকি ঘরের চালা ও রান্নাঘরেও হঠাৎ করেই আগুন লাগছে। নেভাতে গিয়ে পুড়ে আহতও হয়েছেন কয়েকজন। গত এক মাস ধরে হঠাৎ করে লাগা এমন আগুনে আসবাবপত্র পুড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। কিন্তু আগুনের সূত্রপাত আবিষ্কার করতে পারছেন না কেউই।

কখনো রাতে, কখনো সকালে, আবার কখনো বিকেলে। হঠাৎ অলৌকিক এমন আগুনে এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। আতঙ্কে কাজ ফেলে দিন- রাত বাড়ি পাহারা দিচ্ছেন পুরুষরা। আর ঘরের বাইরে রান্না করছেন গৃহিণীরা। অনেকেই সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছেন স্বজনদের বাড়িতে। হঠাৎ করে লাগা এমন অলৌকিক আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় ঘরের জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হচ্ছে। ফলে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন এলাকাবাসী।

গত ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ওই এলাকার আবদুর রহিমের ঘরের বিছানায় আগুন লাগে। ধোঁয়া ও গন্ধ টের পেয়ে বিছানায় লাগা আগুন নিভিয়ে ফেলা হয়। কিন্ত পরদিন সন্ধ্যায় একইবাড়ির পাশের ঘরে রাখা পোশাক পরিচ্ছদে একইভাবে আগুন লাগে। পর্যায়ক্রমে পরবর্তি এক সপ্তাহে ওই বাড়ির সুফিয়ার পাকের ঘর, হায়দারে বিছানা, জাকিরের গোয়ালঘরে একইভাবে হঠাৎ আগুন জ্বলে ওঠে। প্রথমদিকে এটা দূর্বৃত্তদের কারসাজী মনে করে পাহারা দিতে থাকে এলাকাবাসী। কিন্ত এর মধ্যও হঠাতই ঘরের আসবাপত্রে আগুল লাগলে বিষয়টি আলৌকিক এমন ধারণা জন্ম নেয় এলাকায়। ধারণা থেকে তান্ত্রিকদের দ্বারস্থ হন তারা। কিন্ত তন্ত্র মন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে ফের দিনের বেলা আগুন লাগতে শুরু করে। এর মধ্যে অনেকের ঘরের পোশাক ও বিছানাপত্র পুড়ে নিঃশেষ হয়েছে।

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন পোটকাখালীর চা দোকানী আবদুর রহিম। কখনো বিছানা, কখনো জামাকাপড় আবার পাকের ঘর থেকে শুরু করে কাঠের বেড়াও পুড়েছে তার। রহিম জানান, এ পর্যন্ত অন্তত ২০ বার আগুন লেগেছে। পরনে ছাড়া আর কোনো পোশাকই পুড়তে বাকি নেই তার। এ ছাড়া ঘরের এক তৃতীয়াংশ আসবাবপত্র পুড়েছে। বাকি যা আছে তা বাইরে সরিয়ে রেখেছেন। 

শুধু ওই বাড়িতেই না, এ আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের বাড়িতেও। শনিবার (১৩ নভেম্বর) দুপুর পর্যন্ত ওই এলাকার অন্তত ১০ টি ঘরে একইভাবে আগুন লাগা শুরু হয়। কীভাবে এই আগুন লাগছে তা কেউই বলতে পারছেন না। আগুন আতঙ্কে দিন পার করছেন ওই গ্রামের শতাধিক পরিবার। 

ভুক্তভোগী রিপন, সেন্টু, মনসুর আলীসহ এলাকাবাসী বলেন, প্রায় একমাস ধরে বাড়ির যে কোন জায়গায় হঠাৎ করে আগুন লেগে যাচ্ছে। প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ বারের মতো আগুন লাগে। কিন্তু কীভাবে এ আগুন ধরেছে বলতে পারি না। আগুনের ভয়ে পরিবারের স্বজনদের বাসায় একা রেখে কোথাও যেতেও ভয় লাগছে। যদিও প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম হয়তো কেউ আগুন দিচ্ছে। তাই পাহারা বসায় এলাকাবাসী। পরে দেখি কেউ আগুন দিচ্ছে না, এমনি এমনিতেই আগুন লাগছে। আগুনে কখনো কাপড় পুড়ছে, কখনোবা ঘরের জিনিসপত্র। আগুন নেভাতে গিয়ে অনেকেই হাত পা পুড়িয়ে ফেলছে, এ নিয়ে এখন আমরা অনেক আতঙ্কে আছি।

ভুক্তভোগী আলেয়া, রেহেনা, নাসিমা সহ এলাকার গৃহিণীরা বলেন, প্রতিদিন আগুন লাগায় বাড়িতে থাকাই আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ হাত পা পুড়িয়ে ফেলছে। না জানি কখন কার বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যায়। পুড়তে পুড়তে অনেকের পরার মতো কাপড়চোপড়ও নাই। এমন ভাবে কেন আগুন লাগছে তার সঠিক সুরাহা করা হলে আমাদের খুব উপকার হবে।

বরিশালের চাখার সরকারি ফজলুল হক কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক নাজমুল আলম রায়হান বলেন, সোডিয়াম বা ম্যাগনেসিয়ামের মতো ধাতুগুলো খুবই বিপজ্জনক এবং দাহ্য পদার্থ। বিশুদ্ধ সোডিয়াম তো সরাসরি বাতাসের সংস্পর্শে এলেই আগুন ধরে যায় বা বিস্ফোরিত হয়৷ আর ম্যাগনেসিয়ামও দাহ্যতা দেখায়, তবে সোডিয়ামের থেকে কিছুটা কম এবং নিয়ন্ত্রিত। ঘটনাগুলোর বর্ণনা শুনে মনে হয়েছে এক্ষেত্রে ম্যাগনেসিয়াম পাউডার বা ম্যাগনেসিয়ামের স্ট্রিপ ব্যবহার করা হয়েছে। এই বস্তু কোনো দাহ্য জিনিসের সংস্পর্শে রেখে দিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে আগুন জ্বলে উঠবে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ইতোমধ্যে এলাকাটি পরিদর্শন করছেন বরগুনা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা। ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ম্যানেজার বদিউজ্জামান বলেন, হঠাৎ করে এমন আগুন লাগা নতুন নয়। দেশের অনেক স্থানেই প্রায়ই এমন ঘটনা শোনা যায়। স্থানীয়রা এটাকে ভৌতিক বলে মনে করে। ভৌতিক ব্যাপার হতেও পারে। যাই হোক অলৌকিক এমন ঘটনায় যাতে কারো কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য আমরা সজাগ আছি।

বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, রহস্যময় আগুন লাগার বিষয়টি শুনেছি। আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে বলেছি। স্থানীয়রা আলৌকিক ভাবলেও বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে কি কারণে এমন আগুন লাগছে সেটি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

Exit mobile version