Site icon Jamuna Television

ঘুমের মধ্যে সাপের দাঁত ফুটিয়ে স্ত্রীকে খুন! রহস্য উদঘাটন যেভাবে

ছবি: সংগৃহীত।

বিছানার উপর যেন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলেন উথরা। শুধু বাঁ হাতে রক্তের দাগ লেগেছিল। সেটা দেখেই সন্দেহ হয়েছিল তার মায়ের। তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে জানতে পারেন, সাপের কামড়ে অনেক আগেই মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। ভারতে সাপের কামড়ে মৃত্যু খুব সাধারণ বিষয়। কিন্তু মাত্র ২৫ বছরের উথরার এই অস্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নিতে পারছিল না পরিবার। পুলিশে অভিযোগ করেন তারা। খবর আনন্দবাজার পত্রিকা।

তদন্তে যা উঠে আসে তা জানতে পেরে হতভম্ব হয়ে যায় উথরার পরিবার। উথরার মৃত্যুর পিছনে আসল কারণ অবাক হয়ার মতই। সাপের কামড়েই মৃত্যু হয়েছিল তার কিন্তু আসল খুনি ছিল তারই স্বামী! সম্প্রতি কেরালার এই ঘটনা সামনে আসার পর আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।

স্বামী সূর্য কুমারের সাথে উথরার পরিচয় হয়েছিল একটি পাত্র-পাত্রীর ওয়েবসাইটেই। সেখান থেকেই মেলামেশা। একে অপরের প্রেমে হাবুডুবুও খেতে শুরু করেন দু’জনে। শেষে ২০১৮ সালে তারা বিয়ে করেন। অন্য মেয়েদের থেকে একটু আলাদা ছিলেন উথরা। ঠিক মতো কথা বলতে পারতেন না তিনি। তার জন্য এমন একজনের খোঁজ করছিল পরিবার, যিনি উথরাকে সত্যি ভালবাসবেন। উথরার খেয়াল রাখবেন।

সূর্যের বয়স তখন ২৭। ব্যাঙ্কে কাজ করতেন। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল। তার বাবা অটো চালিয়ে আয় করতেন। উথরার বাড়ির লোক মনে করেছিল, সূর্যই উথরার উপযুক্ত স্বামী হয়ে উঠবে। মেয়ের সঙ্গে ঘটা করে তার বিয়ে দেয় তারা। পরবর্তীতে তারা জানতে পেরেছিল, শুধুমাত্র সম্পত্তির লোভেই উথরাকে বিয়ে করেছিল সূর্য। বিয়ের সময় তাই ৭২০ গ্রাম স্বর্ণ, নগদ ৫০ হাজার টাকা এবং একটি গাড়ি যৌতুক নিয়েছিল।

বিয়ের প্রথম কয়েক মাস সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। তাদের একটি ছেলেও হয়। কিন্তু তার পরই শ্বশুরবাড়ির লোকজন বদলাতে শুরু করে। উথরার পরিবারের কাছে আরও অনেক টাকা দাবি করতে শুরু করে তারা। সে সব দাবিও মেনে নেন উথরার বাবা। মেয়ের দেখাশোনার জন্য প্রতি মাসে জামাইকে আট হাজার টাকাও দিতেন। কিন্তু তাতেও সাধ মেটেনি সূর্যের। উথরার শুনতে এবং বলতে পারার সমস্যার কারণে আর তার সঙ্গে সংসার করতে চাইছিল না। অথচ বিচ্ছেদের কোনও অজুহাতও দেখাতে পারছিল না সূর্য। সে কারণেই খুনের পরিকল্পনা করে সে।

২০১৯ সাল থেকেই বিষধর সাপের সম্বন্ধে জানার কৌতূহল জন্মায় সূর্যের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি ইন্টারনেটে সাপের ভিডিও দেখতো। ইউটিউবে বিভিন্ন সাপ বিশেষজ্ঞদের চ্যানেল দেখতো। ওই বছরই ২৬ ফেব্রুয়ারি এক সাপুড়ের কাছ থেকে দশ হাজার টাকার বিনিময়ে বিষধর চন্দ্রবোড়া সাপ কিনেছিল সে। সিঁড়িতে সেই সাপ রেখে উথরাকে দোতলা থেকে মোবাইল ফোন আনার অনুরোধ করেছিল। ভেবেছিল সিঁড়িতে পা দিলেই চন্দ্রবোড়ার কামড় খাবে স্ত্রী। কিন্তু তার আগেই সিঁড়িতে সাপটিকে দেখতে পেয়ে গিয়েছিল উথরা।

সে বার প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল উথরা। বুঝতেও পারেননি স্বামী তাকে খুনের ষড়যন্ত্র করেছিল। এর কয়েক মাস পর আবার ওই একই সাপ বিছানায় ছেড়ে ঘুমের মধ্যে উথরাকে মারার চেষ্টা করেছিল। সাপের কামড় খেয়েও সে বার প্রাণে বেঁচে যান তিনি।

সাপে কামড়ানোর পর সেবার অন্তত ৫২ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন উথরা। এ রকম অবস্থায়ই তার বিছানায় এবার একটি কেউটে সাপ ছেড়ে দেন স্বামী সূর্য। ঘুমের মধ্যে সাপের কামড় খেয়ে যাতে স্ত্রীর ঘুম ভেঙে না যায়, তাই শোওয়ার আগে ফলের রসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়েছিলেন উথরাকে। তৃতীয় বার ভাগ্য সহায় হয়নি তার। এবার কেউটে সাপের কামড়ে মৃত্যু হল তার।

নিথর শরীরে উপরে ঘোরাফেরা করে বিছানা থেকে নেমে যাওয়ার উপক্রম করতেই সাপটির মাথা চেপে ধরে উথরার বাঁ হাতে তার বিষদাঁত নিজে বসিয়ে দেন সূর্য। এই ভাবে দুই বার সাপের দাঁত বসিয়ে দেয় সূর্য। উথরার ময়নাতদন্তের পর একই জায়গায় দুই বার সাপের ছোবল দেখেই সন্দেহ হয় তদন্তকারীদের। কারণ সাপ সাধারণত অকারণে দুই বার কামড় দিয়ে বিষ নষ্ট করতে চাইবে না। পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয় তদন্তকারীদের ভাবিয়ে তুলেছিল।

গভীর রাতে উথরাকে সাপ কামড়েছিল। সর্প বিশারদদের মতে, সাধারণত রাত আটটার পর কেউটে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আর দোতলার যে ঘরে উথরা ছিলেন, সেখানে বাইরে থেকে সাপ ঢোকার কোনও রাস্তাও ছিল না। তার উপর যে সাপটি কামড়েছিল, তাকে পরে ঘরের মধ্যে দেখতে পেয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল উথরার ভাই। সেই সাপ পরীক্ষার পর জানা যায়, এর আগে সাত দিন ধরে সাপটি সম্পূর্ণ না খেয়ে ছিল। বন্য সাপ দিনে দুই বার খায়। তদন্তকারীরা নিশ্চিত হয়, সাপটি সাত দিন ধরে কোথাও বন্দি ছিল। এ ছাড়া সাপের কামড় খাওয়ার পর যন্ত্রণায় উথরার ঘুম ভেঙে যাওয়াও উচিত ছিল।

যার কাছ থেকে সূর্য সাপটি কিনেছিল, তদন্তে তার সন্ধানও পাওয়া যায়। তাকে গ্রেফতারের পরই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয় তদন্তকারীদের সামনে। খুন করে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে দিনের পর দিন ছক কষেছিল সূর্য। সাপ ধরাও শিখে নেয় সে। তাও শেষ রক্ষা হয়নি। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় তার।

Exit mobile version