Site icon Jamuna Television

তাঁত শিল্প এলাকায় বাড়ছে অটিস্টিক-প্রতিবন্ধী শিশু

গোলাম মোস্তফা রুবেল, সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জের তাঁত শিল্প এলাকাগুলোতে দিন দিন বেড়ে চলছে অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুর হার। কারণ হিসেবে জানা যায়, তাঁতের সুতার কাজে ব্যবহৃত বিষাক্ত বর্জ্য আর পানি এই এলাকার ভূগর্ভের নলকুপের পানির স্তরের সাথে মিশে খাবার পানি মারাত্বকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। এই মারাত্বক দূষিত পানি পান করার কারণেই মাতৃগর্ভ থেকেই অটিজম শিশুর জন্ম হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু এই সমস্যার সমাধানে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কোন ধরনের ব্যবস্থা নেন না বলেও অভিযোগ এলাকাবাসীর।

তাঁত ও বস্ত্রশিল্পের জন্য দেশের অন্যতম একটি জনপদের নাম সিরাজগঞ্জ জেলা। তাঁত শিল্পের জন্য ব্যবহৃত সুতা রং এর বর্জ্য মিশ্রিত বিষাক্ত পানি এলাকার জলশায় গুলোতে ফেলা হয়। দীর্ঘদিন যাবত এই বর্জ্য ফেলার কারণে জলাশয় ভর্তি হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে কারখানার মালিকেরা পাইপ দিয়ে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে মিশিয়ে দিচ্ছে। যে কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ছে। এসব এলাকার নলকুপ চাপলেই এখন দূষিত পানি উঠে আসছে। আর এরকম ভয়ানক রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত পানি প্রতিনিয়ত পান করছে এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। যার ফলে গর্ভবতী মায়েরা অটিষ্টিক আর প্রতিবন্ধি শিশুর জন্ম দিচ্ছে।

যমুনা টিভির ইনভেস্টিগেসন ৩৬০ ডিগ্রি টিম এ অঞ্চলের বেশ কিছু নলকুপের পানির নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করেছে। একই সাথে সিরাজগঞ্জ জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরও রাজশাহী জোনাল লেবোরেটরিতে পরিক্ষা করে। পরীক্ষায় পানিতে মারাত্মক ডিজল অক্সিজেন, মেগানিস, ফসফেট, শিশা, মাত্রা অতিরিক্ত আয়রন ও আরসেনিক পাওয়া গেছে। যা মানব শরীরের জন্য বিশাল হুমকি বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।

সরজমিনে জেলার বেলকুচি উপজেলার গাড়ামাসি গ্রামের শহিদুল্লাহ খান ও তার স্ত্রী নাজমা বেগম জানান, তাদের বাড়ীর চার পাশে সুতা রং এর ডাইং ও প্রসেস মিল রয়েছে। এসব মিলের বর্জ্য যুক্ত রঙ্গিন পানি তার বাড়ীর চাপকলে উঠে আসে। এসব পানি দিয়ে নানা রকম গন্ধ থাকলেও বাধ্য হয়েইে পান করতে হয়। যে কারণে তার ৬ বছরের শিশু কন্যা এশা মনি অটিজমের শিকার হয়েছে বলে ধারণা করেছে এশা মনির চিকিৎসক। এ জন্য শহিদুল্লাহ খান ও নাজমা বেগম তারা পরবর্তী সন্তান নিতেও ভয় পাচ্ছে।

এ উপজেলার চালা গ্রামের সাইফুল ইসলাম ও তার স্ত্রী শাহানাজ বেগম জানায়, আজ থেকে সাত বছর আগে তাদের ঘরে একটি পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহন করে অটিজমের শিকার হয়ে। দেশের নামি দামি হাসপাতালের বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েও কোন লাভ হয়নি। চিকিৎসক বলেছেন তার বাড়ীর নলকুপের পানি আর পান করা যাবেনা। বিষয়টি জানতে পেরে এ বাড়ীর পানি নিয়ে পরীক্ষা করে যমুনা টিভির ইনভেস্টিগেসন ৩৬০ ডিগ্রি টিম। পাওয়া যায় মারাত্মক ফসফেট, শিশা ও মাত্রা অতিরিক্ত আয়রন ও আরসেনিক ।

সিরাজগঞ্জ জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ তবিবুর রহমান তালুকদার, এসব তাঁত শিল্প এলাকার সুতা রং কারার প্রসেস ও ডাইং মিলের বিষাক্ত বর্জ্য মিশ্রিত পানি সরাসরি নলকুপের পাইপদিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে মিশিয়ে দিচ্ছে অসাধু মিল মালিকরা। যে কারণে এ অঞ্চলের নলকুপ গুলোর পানিতে মারাত্মক ডিজল অক্সিজেন, মেগানিস, ফসফেট, শিশা, মাত্রা অতিরিক্ত আয়রন ও আরসেনিক পাওয়া গেছে।

সিরাজগঞ্জ সরকারী শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এবং শিশু রোগ বিষেশজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ মোঃ রেজাউল ইসলাম জানান, যদি কোন গর্ভবতী মা কিংবা শিশু ডিজল অক্সিজেন, মেগানিস, ফসফেট, শিশা, মাত্রা অতিরিক্ত আয়রন ও আরসেনিক যুক্ত পানি পান করে তা হলে ঐ গর্ভবতী মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় সন্তান অটিজমের শিকার হতে পারে আবার ছোট শিশুরাও যদি এ পানি পান করে তাহলে তাদেরও প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য প্রফেসর ড. হাবিবে মিল্লাত মুন্না জানান, ভূগর্ভস্থ পানির যথাযথ পরীক্ষার জন্য সরকারের উচ্চ মহলকে কাজ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সেই সাথে জেলার সদর হাসপাতালে অটিজম ও প্রতিবন্ধিদের জন্য আলাদা বিভাগ খোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ওলিউজ্জামান জানান, এ অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষে তামাই ও সমেশপুর গ্রামে দুটি পানি শোধানাগার যন্ত্র বসিয়ে এই এলাকার মানুষের মাঝে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। পর্যায় ক্রমে আরো বাড়ানো হবে। আর প্রতিবন্ধী ও অটিজমের শিকার শিশুদের সরকারী ভাতা এবং সকল সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।

বছর শেষে শুধু একবার করে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন না করে অটিজম ও প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণ গুলো চিহ্নিত করে কর্তৃপক্ষ তা নির্মূলের ব্যবস্থা নেবে এমনটাই প্রত্যাশা করছেন ভূক্তভোগী পরিবারগুলো।

Exit mobile version