Site icon Jamuna Television

৩৫০ টাকায় কেনা ছবির দাম উঠেছে ৮০ কোটি, ৪৩০ কোটি চাচ্ছেন বৃদ্ধা!

টেরি হর্টন ও তার ছেলে এবং আলোচিত সেই পেইন্টিং। ছবি: সংগৃহীত

নিজেকে অর্থলোভী ভাবতে রাজি নন। শুধু তার কেনা পেইন্টিংয়ের ‘সঠিক’ মূল্য চান। আমেরিকার বাসিন্দা টেরি হর্টনের দাবি, এ যেন তেন পেইন্টিং নয়। আমেরিকার বিখ্যাত শিল্পী জ্যাকসন পোলকের আসল শিল্পকর্ম! ফলে লাখ লাখ ডলার নিয়ে ক্রেতারা এগিয়ে এলেও তাদের হাতে সেটি তুলে দিতে রাজি নন ৮৫ বছরের ওই বৃদ্ধা। অন্তত পাঁচ কোটি ডলারে সেই পেইন্টিং বিক্রি করতে চান তিনি। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় প্রায় ৪৩০ কোটি টাকা।

টেরির এমন দাবিতে আমেরিকার শিল্পজগতে বেশ হইচই পড়ে গেছে। ওই পেইন্টিংটি যে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট এক্সপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম শিল্পী জ্যাকসন পোলকের আসল শিল্পকর্ম, তা নিয়েও নানা জন নানা মত রয়েছে। যদিও নিজের দাবিতে অনড় টেরি।

টেনেটুনে অষ্টম শ্রেণির গণ্ডি পার করেছেন টেরি। প্রচলিত অর্থে শিল্পরসিকও নন। টেরির হাতে জ্যাকসন পোলকের আসল শিল্পকর্ম কী করে এলো?

একসময় পেশায় ট্রাকচালক টেরি জানিয়েছেন, ১৯৮৭ সালে একটি সড়কদুর্ঘটনার পর ২০ বছরের চাকরিজীবন থেকে অবসর নেন তিনি। তারপর বিভিন্ন জায়গায় ‘অমূল্য রতন’ খুঁজে বেড়াতেন। কখনও পুরনো জিনিসপত্রের দোকানে, কখনও বা আবর্জনার ভ্যাট এমন কোনও ফেলে দেয়া জিনিস যদি পাওয়া যায়, যার আর্থিক মূল্য আসলে অনেক বেশি। যা বিক্রি করে বেশ কিছু আয় করা যাবে। ১৯৯২ সালে সান বার্নার্ডিনোর একটি সুলভ মূল্যের দোকানে ৬৬x৪৮ ইঞ্চির ওই পেইন্টিংটি চোখে পড়ে। বন্ধুকে উপহার দেওয়ার জন্য মাত্র পাঁচ ডলার দিয়ে তা কিনে ফেলেন টেরি।

পেইন্টিংটি কিনলেও তা বন্ধুকে উপহার দিতে পারেননি টেরি। তার বন্ধুর ট্রেলরের দরজা এতই ছোট যে তা দিয়ে ওই উপহারটি ঘরে ধুকাতে পারেননি। নিরাশ হয়ে ‘ইয়ার্ড সেল’এ পেইন্টিংটি উঠান টেরি। সেই সময়ই ওই পেইন্টিংয়ের সম্পর্কে জানতে পারেন তিনি। ক্যালিফোর্নিয়ার কোস্তা মেসা অঞ্চলের বাসিন্দা টেরির এক প্রতিবেশী আর্টের শিক্ষক তাকে জানান, এই পেইন্টিংটি জ্যাকসন পোলকের আসল শিল্পকর্ম হতে পারে।

জ্যাকসন পোলক আবার কে? ওই আর্টের শিক্ষকের কাছে টেরির প্রথম প্রশ্নই ছিল এটি। শিল্পচর্চা থেকে বহু দূরে থাকা টেরি এবার জ্যাকসন পোলকের সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করেন। ওই পেইন্টিংটি আসল কি না, তা জানতে টেরির ছেলে বিল পেজ একজন ফরেনসিক আর্ট বিশেষজ্ঞকে নিযুক্ত করেন। পল বিরো নামে কানাডার ওই বিশেষজ্ঞ পেইন্টিংটি যাচাইয়ের কাজ শুরু করেন।

ট্রিপল ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিকগনিশন পদ্ধতির মাধ্যমে যাচাই করার পর পল জানান, এটি জ্যাকসন পোলকের আঁকা ‘নম্বর ৫, ১৯৪৮’। এবং এটি আসল পেইন্টিং! পোলকের স্টুডিও থেকে রং ছেটানোর যন্ত্রপাতির পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন তিনি। এমনকি, যাচাইয়ের সময় ওই পেইন্টিংটি ‘নম্বর ৫, ১৯৪৮’এর সঙ্গে পাশাপাশি রেখেও দেখা হয়েছিল। এত কিছুর পর পল নিশ্চিত, এটিই আসল শিল্পকর্ম। এর পর ক্রেতার খোঁজ শুরু করেন টেরি।

কিন্তু পোলকের ‘নম্বর ৫, ১৯৪৮’ নামের পেইন্টিংটি তো ২০০৬ সালেই ১৪ কোটি ডলারে বিক্রি হয়েছিল। তবে এই বহুমূল্য পেইন্টিংটি কীভাবে আসল হয়?

বেশ কিছু দিন পড়াশোনার পর অ্যাবস্ট্র্যাক্ট এক্সপ্রেশনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কেও জানতে পারেন টেরি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিল্পজগতে নতুন চিন্তার আমদানি করেন আমেরিকার একঝাঁক শিল্পী। চল্লিশের দশকে মূলত নিউ ইয়র্ককে কেন্দ্র করে তাদের শিল্পভাবনা বিশ্বের দরবারে পেশ করেন। কোনও বস্তু বা ব্যক্তির প্রকাশ নয়, বরং তাদের শিল্পকর্মে নিজেদের তাৎক্ষণিক আবেগ ফুটিয়ে তোলেন ওই শিল্পী, স্থপতি বা চিত্রকরেরা। অনেকটা চোখ বুজে একটি কাগজের উপর পেন্সিল চালিয়ে দেয়ার মতো। পেন্সিলের আঁকিবুকিতে ফুটে ওঠা রেখাগুলিই এক একটি শিল্পকর্মের রূপ নেয়। অ্যাবস্ট্র্যাক্ট এক্সপ্রেশনিস্ট হিসাবে নিজস্ব ভাবনার পরিচয় দিয়েছিলেন মিউরাল শিল্পী পোলক। বিশালাকায় ক্যানভাসে এলোমেলো ভাবে রং ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতেন তিনি। তার ‘ড্রিপ অ্যান্ড স্‌প্ল্যাশ’ স্টাইলের মাধ্যমে শিল্পরসিকদের মধ্যে নিজের জায়গা গড়ে নেন পোলক।

পলের দাবি সত্ত্বেও ওই পেইন্টিংটিকে আসল বলে মেনে নিতে রাজি নন শিল্পরসিকদের একাংশ এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর আর্ট রিসার্চ (আইএফএআর)। প্রথমত, একটি সুলভ মূল্যের দোকান থেকে তা কেনা। দ্বিতীয়ত, তাতে পোলকের স্বাক্ষর নেই। এবং পেইন্টিংটি ওই দোকানে কীভাবে এলো, সে সম্পর্কেও বিশেষ তথ্য জানা যায় না। ওই দোকানের মালিকও মৃত। দোকানটিরও এখন অস্তিত্ব নেই। যদিও পোলক নিজের বহু পেইন্টিং ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলেন। তবে তার কোনটি কোথায় গেছে, সেসব নিয়েও কোনো তথ্য নেই।

এসবেও নিরাশ হননি টেরি। বৈজ্ঞানিক প্রমাণকে হাতিয়ার করে ক্রেতার খোঁজ চালিয়ে যান। এবার আর্ট ডিলার এবং মার্কেটিয়ার টড ভলপেকে পারিশ্রমিক দিয়ে পেইন্টিংয়ের বিক্রেতার খোঁজ করতে বলেন। ক্রেতাও পেয়ে যান। তাদের এক জন ২০ লাখ ডলার, আর এক জন তো ৯০ লাখ ডলার (বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৮০ কোটি টাকা) পর্যন্ত দিতে রাজি। তবে এত কম মূল্যে বিক্রি করতে রাজি নন টেরি। তার সোজা কথা, এই পেইন্টিংয়ের মূল্য আমি জানি। কমপক্ষে পাঁচ কোটি ডলারের নীচে আমি এটা বিক্রি করব না।

টানাপড়েনের মধ্যে মোবাইল ভ্যানে দিন কাটানো টেরির এই অনড় মনোভাবই তাকে ‘তারকা’ হিসেবে পরিচিতে দিয়েছে। ২০০৬ সালে তাকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করেছেন হ্যারি মোজেস। নিউ ইয়র্ক টাইমস এ এক সাক্ষাৎকারে হ্যারি বলেন, পেইন্টিংটি আসল না নকল, তা আমার তথ্যচিত্রের বিষয়বস্তু নয়। বরং শিল্পজগতের মানুষজন একযোগে যেভাবে এই ক্লাস এইট পাশ করা বৃদ্ধাকে ছোটো নজরে দেখছে, তা দেখানোই আমার লক্ষ্য। তথ্যচিত্র ছাড়াও টক শো বা হামেশাই শিরোনামে উঠে এসেছেন টেরি।

এই পেইন্টিংটি জ্যাকসন পোলকের আসল পেইন্টিং, এটি প্রমাণ করাই যেন টেরির জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেরির ছেলে বিল বলেন, খুব বেশি লোকজন এভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে না। সেজন্য তার কৃতিত্ব প্রাপ্য। প্রথম দিন থেকে কখনও হাল ছাড়েননি। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য দিনরাত লাগাতার চেষ্টা করে গেছেন।

পেইন্টিংটি যে আসল, তা প্রমাণ করতে নতুন তথ্য তুলে ধরেছেন বিল। পোলকবিশেষজ্ঞ প্রয়াত নিকোলাস ক্যারোনকে উদ্ধৃত করে ২০১২ সালে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল আমেরিকার ফাইন আর্ট ইনভেস্টিগেশন। তাতে ক্যারোন স্বীকার করেন, ওই পেইন্টিংটি আসল। তবে প্রকাশ্যে এটি বলতে সাহস পান না।

চার্লস ওয়াং নামে এক গবেষকেরও দাবি, এটি পোলকের হারিয়ে যাওয়া পেইন্টিংয়ের একটি। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে তিনি জানিয়েছেন, পোলকের ‘নম্বর ৫, ১৯৪৮’ নামের পেইন্টিংটি আগে বিক্রি হয়েছিল বটে। তবে টেরির কাছে থাকা পেইন্টিংটি আসলে ‘নম্বর ৫, ১৯৪৮’ এর আদি সংস্করণ। এটি কোনও ভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তা মেরামতির জন্য পোলককে ফেরত দেওয়া হয়েছিল। তবে মেরামতির বদলে একটি নতুন পেইন্টিং করেন পোলক। সেই ‘নম্বর ৫, ১৯৪৮’ ই পরে ১৪ কোটি ডলারে বিক্রি হয়েছিল।

এত বছর ধরে একটিই লক্ষ্য নিয়ে বেঁচে থাকা টেরি বলেন, আমি পোলকের কাছ থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছি… কখনও হাল ছেড়ো না!

সূত্র: লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস।
এনবি/

Exit mobile version