Site icon Jamuna Television

আসিফা ধর্ষণ ও হত্যায় নীরবতা: কাঠগড়ায় ভারতীয় মিডিয়া

জম্মু কাশ্মিরে আসিফা বানু নামে এক শিশুকে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতাদের প্রশ্রয়ে পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা এখন ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ববাসীকে আলোড়িত করছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় আপডেট দেয়া হচ্ছে আসিফা সংশ্লিষ্ট ঘটনার নানা খবর। মামলা-আসামিদের কী অবস্থা, কোথায় বিক্ষোভ হচ্ছে, কোন সেলিব্রিটি আসিফার পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, টুইট করছেন ইত্যাদি জানাতে ব্যস্ত ভারতের মিডিয়া।

কিন্তু মিডিয়ার পেরেশানি মাত্র গত তিন চার দিন ধরে দেখছেন ভারতবাসী। অথচ আসিফাকে হত্যা করা হয় গত জানুয়ারি মাসে। ১৭ জানুয়ারি তার দুমড়ানো মুচড়ানো পঁচাগলা লাশ উদ্ধার করা হয়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা ও স্থানীয় উগ্রপন্থী হিন্দু নেতারা মিলে মুসলিম যাযাবর সম্প্রদায়ের ওই শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যা করেন মূলত তাদেরকে ভয় দেখিয়ে এলাকাছাড়া করতে।

৮ বছর বয়সী আসিফাকে ১০ জানুয়ারি অপহরণ করে স্থানীয় জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে তাকে এনে একটি মন্দিরে রেখে এক সপ্তাহ ধরে গণধর্ষণ করা হয়। সবেশেষে শ্বাসরোধে হত্যা করে খুনিরা। এরপর পাথর দিয়ে থেতলে দেয়া হয় শিশুটির মাথা। বন্দি করে রাখা ও ধর্ষণের পুরোটা সময় আসিফাকে না খাইয়ে রাখা হয়েছিল বলেও জানায় পুলিশ।

বর্বরতা এইসব রূপ প্রকাশ পায় কয়েক দিনের মধ্যেই। ভারতীয় পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের সিনিয়র কর্মকর্তা রমেশ কুমার জাল্লার দুঃসাহসিক চেষ্টায় একে একে গ্রেফতার হয় আট অপরাধীকে। তদন্ত কাজ ও অপরাধীদেরকে আইনের মুখোমুখি করতে গিয়ে জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেন রমেশ কুমার। তাকে হত্যার হুমকি দেয় উগ্রপন্থীরা। এক পর্যায়ে মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করতে বাধা দেন বিজেপিপন্থী আইনজীবীদের একটি দল।

জানুয়ারিতে লাশ উদ্ধার, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসজুড়ে এতসব ঘটনা ঘটেছে। এসবের খবর কাশ্মির থেকে প্রচারিত ও প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে বর্বর এই ঘটনাটি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ খবর হয়ে ওঠতে পারেনি। তবে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে যখন আসিফা হত্যার বিচার দাবিতে কাশ্মিরের গণ্ডি ছড়িয়ে দল-ধর্ম নির্বিশেষে বিক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নামতে শুরু করেন, এবং বিদেশি সংবাদমাধ্যমেও খবর আসা শুরু হয়, তখন জেগে ওঠে ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোও। অথচ ২০১২ সালে বাসে এক হিন্দু তরুণীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় মিডিয়া সাথে সাথেই সর্বোচ্চ কভারেজ দিতে সক্রিয় ছিল। তাহলে কি ভিকটিমের ধর্ম ও জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা নেন ভারতের সাংবাদিকরা?

বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে খোদ ভারতে। রাজনীতিবিদদের অনেকে, এমনকি সাংবাদিকরাও প্রশ্ন তুলছেন মিডিয়া গত তিন মাস ধরে এ ঘটনায় নীরব ছিল কেন? আর এখন কেনোইবা এত সরব হয়ে উঠলো?

বিবিসির ভারত প্রতিনিধি সৌতিক বিশ্বাস এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। তার কাছে কাশ্মীরের স্থানীয় সাংবাদিকরা অভিযোগ করেছেন, তারা জানুয়ারি মাসেই খবরটি প্রচারে নিজ নিজ সংবাদমাধ্যমের (যেখানে চাকরি করেন) দিল্লি অফিসে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু অফিসের সিনিয়র সাংবাদিকরা সেটিকে গুরুত্ব দেননি।

শ্রীনগর ভিত্তিক সাংবাদিক সামির ইয়াসির বিবিসিকে বলেন, ‘এখানকার কিছু রিপোর্টার যখন তাদের দিল্লি অফিসে খবরটি জানিয়ে যোগাযোগ করলেন, তখন মনে হলো, কাশ্মিরে একটি শিশু ধর্ষিত ও খুন হওয়ার ঘটনার চেয়ে সেখানকার কোনো টিউলিপ ফুলের বাগান উদ্বোধনের খবর বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

ইয়াসির বলেন, ‘তাদের বসদের অনেকেই জানালেন এটা অতো বড় কোনো ঘটনা নয়। আর এটি কভার করা জন্য যথেষ্ট জনবলও তাদের নেই। শুধু একটি ইংরেজি ভাষার দৈনিক (দিল্লি ভিত্তিক) ধারাবাহিকভাবে ঘটনাটি ফলোআপ করছিলো।’

২০১২ সালে দিল্লিতে ২৩ বছর বয়সী মেডিকেল ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে দিল্লির রাজপথে ও মিডিয়ায় যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিলো আসিফার ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত কেন? বিবিসির প্রতিবেদন মতে, ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমের বড় অংশটি কাশ্মির ইস্যুতে খুবই পক্ষপাতমূলক আচরণ করে থাকে।

দ্য প্রিন্ট পত্রিকার সম্পাদক শেখর গুপ্ত ২০১৫ সালে বলেছিলেন, ‘ভারতের মূল ভূখণ্ডের মিডিয়াতে কাশ্মিরকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তা-ই মূলত কাশ্মিরের সবচেয়ে বড় সঙ্কট। এটিকে সব সময়ই জাতীয় নিরাপত্তা ও সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তার সাথে মিলিয়ে দেখা হয়। এ কারণে প্রায়ই কাশ্মির সংক্রান্ত অনেক সত্যকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করা হয়।’

আসিফার ক্ষেত্রে হয়তো ‘ধর্মীয় সম্মান রক্ষা’র বিষয়টিও জড়িত ছিলো। এ কারণে জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো এই অপরাধের খবরটি উপক্ষে করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তিন মাস পর মাত্র গত শুক্রবারে নীরবতা ভাঙলেন। একগুচ্ছ টুইট করে ঘোষণা দিলেন, ‘কোনো অপরাধী ছাড় পাবে না। আমাদের মেয়েরা অবশ্যই ন্যায়বিচার পাবে।’

এ বিষয়ে সমাজ বিশ্লেষক ড. বিশ্বনাথান বলেন, দিল্লির সংবাদমাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত হত্যা, ধর্ষণ, সহিংসতা, নির্যাতন, লুটপাটের খবর প্রচার করতে করতে গা সওয়া হয়ে গেছে। এগুলো এখন আবহাওয়া সংবাদের মতো নিয়মিত আইটেমে পরিণত হয়েছে। ড. বিশ্বনাথান বলেন, প্রতিটি খবরেই তারা অতিরঞ্জন কিছু খুঁজতে চায়। যা তাদের নৈতিক বোধকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

ক্ষুব্ধ এই সমাজবিজ্ঞানী বললেন, ‘সবাই অপরাধের সহযোগী। সাধারণ মানুষ, মিডিয়া, রাজনীতিক সবাই। (ভারতে) এখন আর মানবাধিকার বলতে কোনো ধারণা নেই। তার বদলে এখানে হিন্দু অধিকার আর মুসলিম অধিকার আছে। আমাদের আনুগত্য এখন ধর্ম, গোত্র, গোষ্ঠী আর ক্লাবের প্রতি।’

তবে কাশ্মিরের রাজনৈতিক দল আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টির চেয়ারম্যান ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ শেখ রশিদ ভারতীয় মিডিয়াকে সহজে ছাড় দিতে রাজি নন। এতদিন নীরব থাকার কারণে সংবাদমাধ্যমগুলোকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

রোববার এক বিবৃতিতে কাশ্মিরের এই এমএলএ বলেন, ‘তিন মাস ধরে চোখ বুজে থেকে এখন হঠাৎ করে টিভি চ্যানেলগুলো শিশু অধিকার রক্ষায় চ্যাম্পিয়ান হয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা করছে তাতে স্পষ্ট হয়েছে তাদের মুখ বন্ধের নেপথ্যে অন্য কিছু ছিল। তিনি আরও বলেন, ‘এখন প্রতিটা টিভি চ্যানেল ইস্যুটি নিয়ে যেভাবে উচিত ছিল সেভাবেই আলোচনা করছে। কিন্তু গত তিন মাস ধরে তারা কেন নীরব ছিলো সে জবাব দিতে হবে।’

‘ভারত ও বিশ্বের বিবেকবান মানুষকে বুঝতে হবে একটি বর্বর অপরাধের ঘটনা যেটির সাথে দেশের স্বার্থ বিসর্জন হওয়ার কোনোই সম্পর্ক নেই সেটি নিয়ে রিপোর্ট করতে তিন মাস সময় লেগেছে ভারতীয় মিডিয়ার। তাহলে এই মিডিয়া কথিত ‘দেশ-বিরোধী পাকিস্তানী এজেন্টদের’ দমনের নামে কাশ্মিরিদের ওপর যেসব বর্বরতা চালানো হয়, সেগুলো নিয়ে কিভাবে নিরপেক্ষ রিপোর্ট করবে? কুলগামে চারজন সাধারণ নাগরিককে হত্যা করা হলো, অথচ কোনো টিভি চ্যানেল নিরাপত্তা বাহিনীর নৃশংসতা নিয়ে একটি শব্দও প্রচার করলো না। এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কিছু হতে পারে না। আসিফার ঘটনায় কভার করতে এখন (তিন মাস পর) ভারতীয় মিডিয়া বাধ্য হচ্ছে। তাই কারো এটা মনে করা উচিত হবে না যে, উগ্রজাতীয়তাবাদী মিডিয়া রাতারাতি নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ হয়ে গেছে।’

Exit mobile version