Site icon Jamuna Television

সাংবাদিকতা: মহান পেশায় যাত্রা অনিশ্চিত

সাংবাদিকতা বিষয়টা আমাদের অনেকের কাছেই স্বপ্নের। হয়ত একজন বহু বছর আগে একটি বীজ বপন করেছিলেন। সেখান থেকে কারও চারা হয়েছে। কারও আবার ছায়া-সুশীতল বৃক্ষ। স্বপ্নের এই উড়ানের পথটা কতটা কণ্টক, কতটা মসৃণ?

সাংবাদিকতা ‘করার’ আগে ‘পড়ার’ কথা নিয়ে একটু বলি। এ বিষয়ে পড়তে গেলে একটি প্রশ্ন শুনতে হয় সবাইকে। বিশেষ করে ক্লাসে তো বটেই। প্রশ্নটা হচ্ছে, ‘কেনো সাংবাদিকতা পড়তে এসেছো’। এর উত্তরও থাকে রেডি। অমুক চেঞ্জ করব, তমুক চেঞ্জ করব। সমাজের হ্যান করব, ত্যান করব। আসলে চোখে মুখে সে সময় পরিবর্তনের স্বপ্নও থাকে ছেলে-মেয়েদের। সাংবাদিকতার কোনো ছাত্র শুরুতে বানিয়ে এসব কথা বলে না, এটা আমি বিশ্বাস করি।

নিতান্তই ব্যক্তিগত কিছু গল্প করি। তখন আমরা সাংবাদিকতা শুরু করেছি। চোখেমুখে আসলেই কিছু একটা করার স্বপ্ন। কেউ পত্রিকা অফিসে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকি। কেউ আবার তখনকার গুটি কয়েক টেলিভিশনের অলিগলিতে ঘোরাঘুরি করি নিয়মিত।

বলে রাখি, সে সময় সিএসবি নিউজ খুব জনপ্রিয়। আমরাও সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে ফলো করি। আমার তখন অনার্স চলছে, কাজ করি পত্রিকায়। হুট করে একদিন শুনি, সিএসবি চ্যানেল বন্ধ। সরাসরি আমাদের তখন কিছু না হলেও সাংবাদিকতার ভবিষ্যত নিয়ে একটা অশনিসংকেত তখনই পেয়েছিলাম। বন্ধ হল চ্যানেল ওয়ানও। আবারও একটা শঙ্কা। কী হবে এই প্রফেশনের? আসলেই কি ঠিক করছি? এই প্রফেশনে আসার রিস্ক নেব কিনা, এমন নানা প্রশ্ন শুধু নিজেই নিজেকে না, পরিবারের কাছেও শুনতে হয়েছে বহুবার। নবিশ সাংবাদিক হিসেবেও একটা শঙ্কার রেখা তখন থেকেই বলিপাত করেছে মনে।

এ ঘটনাটি বলার একটি কারণ আছে। আমাদের এক বন্ধু খুব ভালো লিখতো। যেকোনো বিষয়ে হুটহাট গালগপ্প লিখে ফেললেও পাঠক হিসেবে অনেকেই গোগ্রাসে গিলতো। পত্রিকা অফিসে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে লিখত ও। যেটাকে বলে ‘কন্ট্রিবিউটিং’। ভাবতাম, আমাদের বন্ধুটি নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে নামকরা রিপোর্টার হবে। পাতাভরে ও লিখবে, আমরা পড়বো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। পর পর দুটি টেলিভিশন আর ‘আজকের কাগজ’ বন্ধ হবার পর সে সিদ্ধান্ত নেয়, সাংবাদিকতা না করার। পরবর্তীতে কী হতো কে জানে। কিন্তু একটা কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আমার সেই বন্ধু সাংবাদিকতা প্রফেশনে না আসায় আমরা একজন ভালো লেখক হারিয়েছি।

হুট করেই পুরনো অনেক কথা মনে হচ্ছে। মনে হবার ঢের কারণও আছে। চোখের সামনে গেল ক’বছরে বেশ কয়েকটি পত্রিকা বন্ধ হতে দেখেছি। টেলিভিশন বন্ধ হতে দেখেছি। এবার কোপটা পড়ল ‘সকালের খবর’র ওপর। অনেক বড় প্রজেক্ট ছিল।  ছিল সুন্দর অফিস। বন্ধু-বড়ভাই-পরিচিত জনদের কয়েকজন শেষ পর্যন্ত-ও ছিলেন ওখানে। আর এখন? লাইট-প্রেস সব অফ।

কেনো হঠাৎ সকালের খবর বন্ধ হল? উত্তর দেবার কেউ কি আছে? থাকলেও যারা ছিলেন, তারা হয়ত নানামুখী চাপের কারণে কিছু বলতে পারছেন না। আর আমার মতো তরুণ যারা কাজ করতেন সেখানে, তারা নিয়মিত বেতনের পাশাপাশি ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী প্রাপ্য টাকার জন্যও হয়ত মুখ ফুটে কিছু বলছেন না। কিন্তু তারাও নিশ্চয়ই দেশ পাল্টানোর স্বপ্ন নিয়েই সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন। করতে চেয়েছিলেন অনেক বড় কিছু। তাদের মানসিক অবস্থা আজ কেমন, সেটা নিশ্চয়ই খানিকটা হলেও আঁচ করতে পারি। হয়ত কোনো প্রফেশনই স্থির না, নিরাপদ নয় কেউই। তবুও কিছুই কি করার নেই? নিরাপত্তা না মিলুক, খানিকটা স্থিরতা তো আসতেই পারে। মন্দের ভালো বৈকি। তাহলে হয়ত আরও অনেক প্রতিভাবান সাংবাদিকতায় আসতে আগ্রহী হবে।

আর একটা অনুরোধ, পত্রিকা করার আগে আরেকটু ভাববেন। বেশি করে ভাববেন। এটা কে শুধু ‘মানি মেকিং প্রজেক্ট’ ভাববেন না। চিন্তা করবেন, একটি পত্রিকা করা অনেক বড় কিছু, অনেক ভার বইবার বিষয়। সেই সক্ষমতা কি আপনার/আপনাদের হয়েছে? ‘ঘাড়ে জোর না থাকলে, রাইফেলের বায়না নিতে নেই’- পুরনো প্রবাদটি কি ভুলে গেলে চলবে?

মুরশিদুজ্জামান হিমু: সাংবাদিক

Exit mobile version