Site icon Jamuna Television

জাপানে ২টি পরমাণু বোমা হামালার শিকার হয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি!

২টি পরমাণু বোমা হামালার শিকার হয়েও বেঁচে জাপানি সুতোমু ইয়ামাগুচি। ছবি: সংগৃহীত।

কথায় আছে ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়’। জাপানের এই সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া ‘অভাগা’র যাওয়া-আসার পথে সাগরের পানি শুকায় না। পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ হয়! তিনি এমনই অভাগা যে, জাপানের হিরোশিমা পরমাণু হামালার দিন সেই শহরে ছিলেন আবার নাগাসাকিতে পরমাণু হামলার দিন সেখানে ছিলেন। সৌভাগ্যের বিষয় হলো তিনি দুটি পরমাণু হামলার শিকার হয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন।

সেই ‘অভাগা’র নাম সুতোমু ইয়ামাগুচি। জাপানের সুতোমু হিরোশিমার পরমাণু বিস্ফোরণের সময় হিরোশিমায় ছিলেন। আবার তার ঠিক তিন দিন পর যখন নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলা হল, তখন সেখানেও উপস্থিত ছিলেন তিনি।

নাম সুতোমু ইয়ামাগুচি। জাপানের সুতোমু হিরোশিমার পরমাণু বিস্ফোরণের সময় হিরোশিমায় ছিলেন। আবার তার ঠিক তিন দিন পর যখন নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলা হল, তখন সেখানেও উপস্থিত ছিলেন তিনি। অদ্ভুত ভাবে প্রতি বারই বিস্ফোরণস্থল থেকে তার দূরত্ব ছিল ৩ কিলোমিটারের। ফলে বিস্ফোরণের তীব্রতায় গুরুতর জখম হন। সাময়িক অন্ধ হয়ে যান, শ্রবণশক্তিও হারিয়ে যায় তার। তার পরও বেঁচে যান।

পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার সুতোমু জাপানের সংস্থা মিৎসুবিশির জন্য তেলবাহী জাহাজের নকশা করতেন। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট কাজের সূত্রেই তিনি ছিলেন হিরোশিমায়। তিন মাসের কাজের সফর সেরে সে দিনই তার বাড়িতে ফেরার কথা ছিল হিরোশিমা থেকে। সকালে দুই সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে হিরোশিমা স্টেশনের দিকে রওনাও হয়ে গিয়েছিলেন সুতোমু। কিন্তু মাঝপথ থেকে ফিরে আসতে হয় তাকে।

জাপানে যে কোনও সরকারি সেবা পেতে যে পরিচয়পত্র তার নাম হ্যাংকো। সুতোমুর হঠাৎই খেয়াল হয় তিনি হিরোসিমায় তার অফিসে নিজের হ্যাংকোটি ফেলে এসেছেন। সহকর্মীদের স্টেশনে যেতে বলে আবার অফিসের দিকে রওনা হন সুতোমু।

ঠিক সকাল সোয়া ৮টায় সুতোমু যখন অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন, নিশ্চিন্তে হাঁটছেন বন্দরের পাশ দিয়ে, তখনই
বিস্ফোরণ ঘটে। যুক্তরাস্ট্রের বোমারু বিমান ‘এনোলা গে’ হিরোশিমা শহরের ঠিক মাঝখানে নিক্ষেপ করে পরমাণু বোমা ‘লিটল বয়’।

নিজের বইয়ে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণায় সুতোমু লেখেন, তিনি বোমারু বিমানটিকে আকাশে দেখেছিলেন। ঠিক তখনই দু’টি প্যারাশ্যুটকেও নামতে দেখেন। সুতোমুর কথায়, ‘তার পরই আকাশে একটা প্রচণ্ড আলোর ঝলকানি দেখা যায়, আর আমি ছিটকে গেলাম।’

হিরোশিমার ওই বিস্ফোরণে কানের পর্দা ফেটে গিয়েছিল সুতোমুর। কিছু ক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
বিস্ফোরণস্থলের কাছে থাকায় রাসায়নিক বিকিরণে শরীরের চামড়া অনেকটাই ঝলসে যায়। জ্ঞানও হারান তিনি।

জ্ঞান ফিরার পর প্রথমেই দুই সহকর্মীর খোঁজ করেন সুতোমু। তাদের খুঁজে না পেয়ে আহত শরীরেই উঠে পড়েন বাড়ি ফেরার ট্রেনে। পরমাণু বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হিরোশিমায় অদ্ভুত ভাবে তখনও ট্রেন চালু ছিল!

সুতোমুর বাড়ি নাগাসাকিতে। হিরোশিমার দুর্ঘটনার পরের দিনই ৭ অগস্ট নিজের শহর নাগাসাকি পৌঁছন তিনি। মারাত্মক আহত হওয়া সত্ত্বেও গায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে ৯ অগস্ট হাজির হন কাজে। তাকে দেখে অবাক হয়ে যান তার অফিসের সহকর্মীরা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে হিরোশিমার ঘটনার বিবরণ দেয়ার সময় তিনি সুতোমুকে ‘পাগল’ বলে ঠাট্টাও করে। ঠিক তখন, ৯ অগস্ট সকাল ১১টায় পরমাণু বিস্ফোরণ হয় নাগাসাকিতে।

সুতোমুর অফিস থেকে ঠিক তিন কিলোমিটার দূরে ফেলা হয় আমেরিকার পরমাণু বোমা ‘ফ্যাট ম্যান’। এ বারও বেঁচে যান সুতোমু। তবে শারীরিক আঘাত না পেলেও নাগাসাকির বিস্ফোরণের পর টানা এক সপ্তাহ ধূম জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন সুতোমু। টানা বমিও হতে থাকে তার।

নাগাসাকি বিস্ফোরণের সময় সুতোমুর স্ত্রীও ছিলেন শহরেই। তিনিও বেঁচে যান। দু’জনে এরপর দুই কন্যা সন্তানের জন্মও দেন। তখনও সরকারি খাতায় তিনি শুধু নাগাসাকির বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে ফেরা মানুষ। তার হিরোসিমার অভিজ্ঞতার কথা তখনও জানতো না সরকার। অথচ সুতোমুর সন্তানেরা সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এবং শারীরিক ক্ষতির ভার বয়ে নিয়ে চলেছে নিজেদের শরীরে।

বয়স যখন প্রায় আশি তখন সুতোমু ঠিক করেন তার অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাখবেন। পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা জানাবেন দেশের মানুষকে। সুতোমুর সেই বই অবাক করে দেয় জাপানের মানুষকে।

২০০৬ সালে তাকে নিয়ে তৈরি হয় তথ্যচিত্র। সেখানে শক্তিশালী দেশগুলির উদ্দেশে একটি বার্তা দিয়েছিলেন দুই বার পরমাণু বোমাকে ধোঁকা দেয়া সুতোমু। বলেছিলেন, আপনারা দয়া করে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করুন। অস্ত্র তৈরি করা বন্ধ করুন। ২০০৯ সালে হলিউডের পরিচালক জেমস ক্যামেরন দেখা করেন তার সাথে। তাকে নিয়ে ছবি বানানোর কথাও বলেন। তবে তত দিনে অসুস্থ হয়ে পড়েন সুতোমু।

পরমাণু বিকিরণের তীব্র প্রভাব পড়েছিল তার শরীরে। শেষ বয়সে ছানি, লিউকোমিয়ার মতো অসুখে পড়েন। ২০০৯ সালে সুতোমু জানতে পারেন তিনি পাকস্থলীর ক্যানসারেও আক্রান্ত। তত দিনে স্ত্রীকে হারিয়েছেন ক্যানসারে।

ঠিক এই সময়েই সুতোমুর মনে হয় তার জোড়া পরমাণু বোমা অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি থাকা দরকার। ভবিষ্যতে পরমাণু অস্ত্র সম্পর্কে সাধারণ মানসে সচেতনতা তৈরি করতেই ওই স্বীকৃতি দরকার। সরকারের কাছে তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে আবেদন করেন। আর স্বীকৃতি পেয়েও যান। তিনিই একমাত্র, যার দু’টি বিস্ফোরণেরই সাক্ষী হওয়ার কথা মেনে নিয়েছে জাপানের সরকার। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে মারা যান সুতোমু।
সূত্র:হিস্টোরি ডট কম

এনবি/

Exit mobile version