Site icon Jamuna Television

জীবনে ফেরার গল্প: জেলে নৌকার সহকারী থেকে দস্যুনেতা

সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রাণ। ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে এই ব-দ্বীপ অঞ্চল রক্ষার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ। শ্বাপদসংকুল এ অরণ্যের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে লাখ লাখ মানুষ। নিরন্তর সংগ্রাম করে চলা এই বনজীবীদের কাছে আতঙ্কের নাম একেকটি দস্যুবাহিনী। সুখের কথা, এই দস্যুবাহিনীগুলো একে একে আত্মসমর্পণ করছে, আইনের কাছে নিজেদের সোপর্দ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। আর এই আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াটিতে মধ্যস্থতা করেছেন একজন সাংবাদিক। তিনি মোহসীন-উল হাকিম। ধারাবাহিকভাবে লেখছেন তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প। যমুনা অনলাইনের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

সাবেক বনদস্যু ইলিয়াসের বাড়িতে যাব যাব করে প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেছে। খুলনা নগর নির্বাচনের আগেই সেদিন একবেলা সময় বের করে রওনা দিলাম। ডুমুরিয়ার প্রত্যন্ত সেই গ্রামে যেতে সময় লেগেছিল প্রায় দুই ঘণ্টা। ভদ্রা নদীর পাশে নিরিবিলি এক গ্রামের মধ্যে সত্যিকারের প্রশান্তির ছোঁয়া পেলাম সেদিন। এক সময়ের দুর্ধর্ষ জলদস্যু জীবনে ফিরেছে, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নতুন করে গড়ে জীবনটাকে সাজাচ্ছে।

সেদিন আমার সঙ্গী হয়েছিলেন বায়েজিদ ইসলাম পলিন, আর হঠাৎ করেই যোগ দিয়েছিলেন সৌমিত্র দাস শুভ্র। ছোট্ট বাড়ির চারপাশে মাছের ঘের। নতুন করে লাগানো গাছগুলো পুরনো গাছগাছালির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে। উঠোনে অনেকগুলো বাচ্চা নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে মা মুরগি। ছোট ছোট হাঁসের ছানাগুলো খেলছে, খেলছে ইলিয়াসের ছোট্ট কন্যা ফাতেমা।

আত্মসমর্পণের পর জেল থেকে জামিন নিয়ে বের হতে ইলিয়াসের সময় লেগেছিল প্রায় নয় মাস। ঠাণ্ডা মাথায় সেই কঠিন সময় পার করে গ্রামে ফিরেছে সাবেক এই বনদস্যু।

তার পর চলার পথের মোড়ে মোড়ে প্রতিবন্ধকতা। তারপরও সবকিছু কাটিয়ে ইলিয়াসের জীবনে ফেরার চেষ্টা প্রায় সফল। আরে সেটা দেখে সত্যিই ভালো লেগেছে।

এবার এই ইলিয়াসের দস্যু হয়ে ওঠার গল্পটি বলি….

জেলে নৌকার সহকারী থেকে কয়েক বছরের মধ্যে দস্যু নেতায় পরিণত হয়েছিল ইলিয়াস। প্রায় এক যুগ আগে বনদস্যু রাজু বাহিনী তাকে অপহরণ করে। তারপর মুক্তিপণ দাবি করলেও ইলিয়াসের মহাজন বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি। মুক্তিপণ দিয়ে কেউ তাকে ছাড়িয়ে নিল না। সেই অভিমান থেকে দস্যুতের সঙ্গে মিশে যায় সে।

এদিকে দস্যুনেতা রাজুর চোখে পড়ে যায় কয়রার মহেশ্বরীপুরের ছোটখাট ছেলেটি। ধীরে ধীরে বিশ্বস্ততা অর্জন করে ইলিয়াস। অন্যদিকে, ট্রলারের কাজ জানতো বলে রাজুও তাকে দলে ভিড়িয়ে নেয়। ইলিয়াসের হাতে তুলে দেয়া হয় একটি থ্রি নট থ্রি বন্দুক।

ইলিয়াসের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ২০১০ সালে। তখন রাজু বাহিনীর শেষের সারির সদস্য সে। সারাদিন নানা জনের সঙ্গে নানা কথাবার্তা হলেও সে সময় ইলিয়াসের সঙ্গে মাত্র দুই এক লাইন কথা হয়। সেদিন আমাদের তেমন একটা পাত্তা দেয়নি সে। আবার ছবি তুলতেও আপত্তি জানায়নি। বরং তার সামনে যেতেই অস্ত্র হাতে নিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ভাল করে তার ছবি নিতে বললো সে। ইলিয়াস সম্পর্কে তখন থেকেই অন্য রকম ধারণা তৈরি হয় আমার মধ্যে।

কয়েক মাসের মধ্যেই র‌্যাবের অভিযানে রাজু বাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। রাজু তার বড় ভাই ওহিদ মোল্লাকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। অস্ত্রশস্ত্রসহ তার দস্যুবাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে যায় আরেক দস্যু রামপালের শহীদুলের হাতে। পরবর্তীতে ভারত থেকে রাজুর নির্দেশে ইলিয়াসকে করা হয় বাহিনী প্রধান।

২০১২ সালের পর থেকে এই ইলিয়াস বাহিনীর দাপটে বাকী দস্যুরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ডাকসাইটে সব দস্যুরা যোগ দেয় ইলিয়াসের সঙ্গে। ৬০/৭০ জনের সেই দস্যু দল চলাফেরা করতো তিনটি বড় বড় ট্রলারে।

২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমি দেখা করতে যাই ইলিয়াস বাহিনীর সঙ্গে। মোংলা থেকে রওনা দিয়ে অসংখ্য ছোট ছোট খাল-নদী পারি দিয়েছিলাম সেবার। পুরো দুই দিন ট্রলার চালিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছাই ইলিয়াস বাহিনীর কাছে। তখন রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। দেখা হলো শিবসা নদীর পারে বড় নিশানখালী খালের মুখে।

আমাদের ট্রলারের সহযাত্রী সব মিলিয়ে ১১জন। ছোট্ট এক ট্রলার নিয়ে দস্যুদের ট্রলারের কাছে যেতেই ইলিয়াস সালাম দিয়ে আমাকে নিজের ট্রলারে টেনে নিলো। আমাদের অবস্থা দেখে তারা বেশ মজা নিচ্ছিল। এত ছোট ট্রলার নিয়ে এতদূর গেছি, আবার এতগুলো লোক নিয়ে! এসব কথাবার্তা বলতে বলতে পাশের ছোট একটি খালে ঢুকে পড়লাম আমরা।

সেখানে আরও দুটি ট্রলার ভর্তি সশস্ত্র মানুষ। ছিল বেশ কয়েকটি অপহৃত জেলে নৌকা, ত্রিশ জনের মতো অপহৃত জেলে আর একটি ধরা মধুর নৌকা।

পরের দিন চলে আসার কথা থাকলেও তিনদিন সেখানে ছিলাম। ভেবেছিলাম আতিথেয়তা দেয়ার জন্য আমাদের থাকতে বলেছিল তারা। কিন্তু পরে বুঝলাম, নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তখন আমাদের ছাড়া হয়নি। তৃতীয় দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের খবর পেয়ে দ্রুত আমাদের বিদায় দেয়া হয়। তারাও নিরাপদ এলাকায় সরে যায়।

সেই সফরের সঙ্গী হয়েছিলেন সাংবাদিক রহমান মাসুদ, আমার তৎকালীন সহকর্মী শেখ জালাল, রামপালের স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক ও সুন্দরবনের মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল হাকিম। এছাড়া আমার সব সময়ের সঙ্গী বেলায়েত সরদার, ট্রলার মালিক মুকুলসহ কয়েকজন সঙ্গী হয়েছিলেন।

সেই দফায় বারবার আত্মসমর্পণ করতে বলি তাদের। উত্তর ছিল সোজা সাপ্টা ‘না’। আমি জানতাম, ভারত থেকে দস্যু নেতা রাজুই তাদের পরিচালনা করছিল। আর তার নির্দেশ ছাড়া এখানে গাছের পাতাও নড়বে না। ফিরে আসি সেখান থেকে। এর পর ইলিয়াস সহ বেশ কয়েকজন দস্যুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সে বছরেই দস্যু সরদার ইলিয়াস ভারতে পালিয়ে যায়।

২০১৬ সালের মে মাসে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরপরই ভারত থেকেই ফোনে যোগাযোগ করেন ইলিয়াস। আত্মসমর্পণের সুযোগ আছে কিনা তা জানতে চায় সে। তারপর দেড় দুই মাসের মধ্যে ইলিয়াস আবারও ফিরে আসে বাংলাদেশে।

সুন্দরবনের ভেতরে লুকিয়ে রাখা ৭টি অস্ত্র বের করে আমাদের খবর দেয় সে। র‌্যাব ৮ এর সেই সময়ের অ্যাডজুটেন্ট এএসপি জসীম উদ্দীনের নেতৃত্বে একটি দলসহ আমরা সুন্দরবনে প্রবেশ করি। সেই রাতেই ইলিয়াস অস্ত্র গুলিসহ র‌্যাবের হেফাজতে আসে। পরদিন মজনু বাহিনীর সদস্যদেরও বন থেকে উঠিয়ে আনা হয়। পুরো অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন র‌্যাব-৮ এর সেই সময়ের উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবীর।

পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র গুলি জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে সুন্দরবন আর বঙ্গোপসাগরের ত্রাশ ইলিয়ার বাহিনী ও মজনু বাহিনী।

একসঙ্গে দীর্ঘদিনের পুরনো দাপুটে দস্যুবাহিনীর আত্মসমর্পণে তখন স্বস্তি এসেছিল উপকূলে। জীবনে ফিরেছিল দুই বাহিনীর দস্যুরা। আর জীবন নিরাপদ হয়েছিল অন্তত লাখ খানেক মানুষের।

বনদস্যু ইলিয়াস বাহিনীর গল্প এখনও সুন্দরবনের জেলে বাওয়ালীদের মুখে মুখে। কারণ, রাজু বাহিনীর পর সবচেয়ে দাপুটে দস্যু দলের নেতৃত্ব দিয়েছে ইলিয়াস। সেই ইলিয়াস এখন বলেন, একশটা অস্ত্র হাতে তুলে দিলেও দস্যুতা করতে পারবে না সে। কারণ, মনে তার মায়া জমে গেছে….

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন
যমুনা অনলাইন: এমএইচ/টিএফ

Exit mobile version