Site icon Jamuna Television

জীবনে ফেরার গল্প: অস্ত্র ছেড়ে শক্ত হাতে ধরেছে সংসারের হাল

সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রাণ। ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে এই ব-দ্বীপ অঞ্চল রক্ষার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ। শ্বাপদসংকুল এ অরণ্যের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে লাখ লাখ মানুষ। নিরন্তর সংগ্রাম করে চলা এই বনজীবীদের কাছে আতঙ্কের নাম একেকটি দস্যুবাহিনী। সুখের কথা, এই দস্যুবাহিনীগুলো একে একে আত্মসমর্পণ করছে, আইনের কাছে নিজেদের সোপর্দ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। আর এই আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াটিতে মধ্যস্থতা করেছেন একজন সাংবাদিক। তিনি মোহসীন-উল হাকিম। ধারাবাহিকভাবে লেখছেন তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প। যমুনা অনলাইনের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

জীবনে ফেরার গল্প (১৯-তম কিস্তি)

জীবনে ফিরে তারা বদলে ফেলেছে সব। অস্ত্র ছেড়ে শক্ত হাতে ধরেছে সংসারের হাল। অভাব অনটনের মধ্যেও নতুন করে জীবনকে সাজানোর চেষ্টায় সাবেক বনদস্যুরা….

রামপালের প্রসাদনগর। বাগেরহাটের প্রত্যন্ত এই গ্রামের প্রায় সবারই সংসার চলে ঘেরবাড়ি করে। ঘেরবাড়ির অর্থ হলো, মাছের ঘের। নিজের জমি না থাকলেও কয়েক জনের জমি ‘হাড়ি’ বা ভাড়া নিয়ে এই অঞ্চলে মাছের ঘের করে স্থানীয়রা।

সারা বছর বাগদা আর হরিণা চিংড়ির চাষ হয় সেখানে। পাশাপাশি পারশে মাছ, ভেটকি মাছ, ভাঙ্গন মাছসহ বিভিন্ন সাদা মাছেরও চাষ হয়ে সেখানে। বর্ষা শুরু হতেই ছাড়া হয় রুই-কাতলা। চার মাসের মধ্যে সেই মাছ উঠিয়ে বিক্রি করে দেয় তারা। এক কথায় সারা বছরই এখানে চলে মাছের কারবার।

পাশেই পশুর নদ। লবণ পানি টেনে নিয়ে প্রায় দুই যুগ আগে থেকেই চিংড়ির ঘের শুরু হয় এ অঞ্চলে। এখন পুরো এলাকাই লবণাক্ত। চাষবাষের বালাই নাই। তাই ‌এলাকায় নোনা পানির মাছ চাষ ও বেচাকেনার সঙ্গে যারা জড়িত নয়, তাদের বড় অংশ চলে যায় সুন্দরবনে। বনের খাল নদীতে মাছ ধরে জীবন চলে তাদের। এদেরই কেউ কেউ নেমে পড়েছিল দস্যুতায়। কেউ দুই বছর, কেউ বা দশ বছর পর্যন্ত। অন্ধকার জীবনের অলিগলি ঘুরে এখন তারা সবাই আলোকিত জীবনের পথে।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। ক’দিন আগে ঘুরে আসলাম প্রসাদনগর। সাবেক বনদস্যু অলি আব্বাসের বাড়িতে দাওয়াত ছিল। আরেক জন সাবেক বনদস্যু খালিদ চায়ের দোকান দিয়েছে প্রসাদনগর বাজারে। বিকেলে তার দোকানে চায়ের দাওয়াত ছিল।

খালিদ দস্যুতা করেছে কয়েক বছর। বিভিন্ন বাহিনীতে কাজ করলেও সবশেষ বড় ভাই বাহিনীর কাছে গিয়ে দেখা তার সঙ্গে। সেই বাহিনীর সঙ্গেই অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে সে।

খালিদের চায়ের দোকানে

অস্ত্র ছেড়ে এখন বাড়ি ফিরেছে খালিদ। ঘের করার মতো টাকা হাতে ছিল না। তাই সরকারের দেয়া টাকা দিয়ে নিজের গ্রামের বাজারে চায়ের দোকান দিয়েছে। খালিদের সংসার চলছে এই দোকানের রোজগার দিয়ে। কষ্ট হচ্ছে খুব। তারপরও চেষ্টা চলছে ঘুরে দাঁড়ানোর। মামলার জটগুলো কাটলে এই ব্যবসার পাশাপাশি মাছ অথবা কাঁকড়া কেনাবেচার ব্যবসা শুরু করবে সাবেক এই দস্যু।

বিকেল গড়াতেই গ্রামের সেই ছোট্ট বাজারে লোকজন আসতে শুরু করলো। দেখতে দেখতে বাজার ভরে গেল। চা খেতে খেতে দেখা হয়ে গেল আরও বেশ কয়েকজন আত্মসমর্পণ করা সাবেক বনদস্যুর সঙ্গে। এদের সবার চেহারা আর চলন বলনে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। বনের ভেতরে তাদের যে রুক্ষ চেহারা দেখেছিলাম, তার কিছুই অবশিষ্ট নাই।

কেউ ঘেরবাড়ি করছে, কেউ পোনা মাছের ব্যবসা করছে, কেউ বা ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে। অনেকে আবার শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশেপাশের বিভিন্ন অবকাঠামোর নির্মাণ কাজে। এদের অনেকেরই সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। তবে আত্মসমর্পণের পর প্রধানমন্ত্রীর দেয়া অর্থ সহায়তায় কিছু একটা করার প্রবণতা দেখলাম সবার মধ্যেই।

র‍্যাবের মাধ্যমে অস্ত্র জমা দিয়ে দস্যুতা ছেড়ে জীবনে ফিরেছে সবাই। এদের দেখভালও করছে র‍্যাব। যেকোনো সমস্যায় স্থানীয়রাও তাদের সহযোগিতা করছে। মূলত সেকারণেই এরা দস্যুতা ছেড়ে নিজের বাড়িতে উঠতে পেরেছে, নির্বিঘ্নে বসবাস করছে স্ত্রী সন্তান আর বাবা মা এর সঙ্গে।

খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম, আমাদের মধ্যস্থতায় আত্মসমর্পণ করা সুন্দরবনের দস্যুদের মধ্যে অস্তত পঞ্চাশ জনের বাড়ি রামপালের প্রসাদনগর-রাজনগর এলাকায়। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন জেগেছে, এই অঞ্চলের এত তরুণ দস্যুতায় গিয়েছিল কেন? এর উত্তর কর্মসংস্থানের সংকট আর গ্রাম্য রাজনীতির প্রভাব। এদের জীবনকে সুস্থির ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। তা না হলে পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলের অন্য তরুণরাও চলে যাবে দস্যুতায় অথবা অন্য কোনো অপরাধের জীবনে।

দস্যুতা ছেড়ে জীবনে ফিরে আসা সাবেক দস্যুদের কর্মসংস্থান স্থিতিশীল করতে হবে সবার আগে। সাবেক এই বনদস্যুরা মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখেছে। তাই প্রত্যাশা বেশি কিছু না। জীবনে ফিরতে পেরে কৃতজ্ঞ তারা, তাদের স্বজনেরা এমন কী তাদের প্রতিবেশীরাও। ‌এক সময়ের বনের সশস্ত্র আর হিংশ্র দস্যুদের সমাজে ফিরেছে, মিশে যাচ্ছে মূল স্রোতে।

দেখতে ভালই লাগে। ভাল লাগাটা দীর্ঘস্থায়ী হবে তখন, যখন স্থায়ীভাবে পুনর্বাসিত হবে সমাজ থেকে ছিটকে পড়া এই তরুণরা।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন
যমুনা অনলাইন: এমএইচ/টিএফ

Exit mobile version