Site icon Jamuna Television

মদ্রিচের বিশ্বকাপ যাত্রায় ইতি টানলেন ‘আসল’ এলএমটেন

ছবি: সংগৃহীত

দুইজনই ‘এলএমটেন’। দুইজনই নিজ নিজ দলের প্রাণভোমরা। কিন্তু কাতার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে যখন মুখোমুখি হলো আর্জেন্টিনা ও ক্রোয়েশিয়া, মূলত তখনই নির্ধারিত হয়ে গেলো, একজনকে তো বাদে পড়তেই হবে। কে কাকে ছাপিয়ে যাবে ‘আসল’ এলএমটেন হওয়ার লড়াইয়ে, মূল লড়াইয়ের পাশে যেন লেখা হয়ে গেল খণ্ডযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। এল ক্লাসিকোর বহু মহারণের মতো আরও একবার মেসি ম্যাজিকের দর্শক হয়ে শেষমেশ বিদায় নিলেন মিডফিল্ড জেনারেল লুকা মদ্রিচ। আর পায়ের জাদুতেই যিনি দিয়ে থাকেন সকল প্রশ্নের উত্তর, সারা বিশ্বের গণিত ফুটবল ভক্তদের কাছে যেন আরও একবার সেই ক্ষুদে জাদুকরের হয়েই সাক্ষ্য দেবে লুসাইলের আইকনিক স্টেডিয়ামের প্রতিটি ঘাস, লিওনেল মেসিই এলএমটেন, আদি ও অকৃত্রিম।

আবারও মুখোমুখি হলেন লিওনেল মেসি ও লুকা মদ্রিচ। ফুটবল বিশ্বের চিরন্তন যুদ্ধ বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি গায়ে অনেকবারই এল ক্লাসিকোর মহারণে লড়েছেন এই দুই ক্ষণজন্মা ফুটবলার। কিন্তু আজকের মঞ্চ ছিল আরও জমকালো, আরও বিশাল। লুকা মদ্রিচ চেষ্টা করেছেন। যতক্ষণ মাঠে ছিলেন, পুরো সময়ই বারবার একাধিক ব্যারিয়ার ভেঙেছেন। সংযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করে গেছেন রক্ষণের সাথে মাঝমাঠের কিংবা, মাঝমাঠের সাথে আক্রমণভাগের। মদ্রিচের পায়ের জাদু বেশ কয়েকবার দেখা গেছে বিশ্বকাপের শেষ চারের এই মহা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেও।

তবে মাঠে লিওনেল মেসিও থাকলে প্রেক্ষাপটের সাথে দৃশ্যপটের কিছুটা বৈপরীত্য হতেই পারে! মদ্রিচের মতো পুরো মাঠে চষে বেরানো মেসির খেলার ধরন নয়। যখন গতি বাড়িয়েছেন, গড়ে দিয়েছেন ব্যবধান। ইস্পাতদৃঢ় স্নায়ুর পরিচয় দিয়ে লিভাকোভিচকে পরাস্ত করেছেন এমন এক পেনাল্টিতে, যা ঠেকানোর সাধ্য হয়তো নেই বিশ্বের কোনো গোলরক্ষকেরই। স্পটকিকের সময় ক্রোয়াট গোলকিপার শুরুতেই ডাইভ না দিয়ে শটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে কাজে লাগান তার লম্বা শরীর এবং বিদ্যুৎগতির রিফ্লেক্স। সেটা মেসির জানা ছিল অবশ্যই। তার নেয়া স্পটকিকে তাই ছিল না লিভাকোভিচকে বিভ্রান্ত করার কোনো চেষ্টা। বরং, লিও মেসি কোনদিকে শট মারতে যাচ্ছেন তা অনুমান করে সঠিক দিকেই ডাইভ দিলেন ক্রোয়াট গোলকিপার। আর মেসির হয়তো অজানা ছিল না লিভার এই অনুমানও। এমন এক শটই তিনি নিলেন, যা ঠেকানো যেকোনো গোলরক্ষকের জন্যই দুঃসাধ্য নাকি অসাধ্য, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে।

ডেড বলের কথার পর আসা যাক ওপেন প্লে নিয়ে। মেসি যেভাবে খেললেন তাতে যেন চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গেলেন সময়কেও! ৩৫ বছর বয়সী এই ফুটবল বিস্ময়ের ড্রিবলিং, ডিফেন্স চেরা রান কিংবা পাসে ধারাভাষ্যকাররাও বারবার বলতে বাধ্য হলেন, ধন্দে পড়ে যাচ্ছেন তারা! বয়স কি তার জন্য উল্টো দিকে ছুটছে নাকি! সম্ভাব্যতার সকল সীমাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন যিনি ক্যারিয়ার জুড়েই, ক্রোয়াটদের দুর্ভেদ্য ডিফেন্সকে বারবার ভেঙে যেন মদ্রিচদের আবারও দেখালেন, জীবন্ত দৈবের সামনে কতটা অসহায় নশ্বর মানুষ!

৬৯ মিনিটের গোল নিয়ে কথা বলতে গেলে চলে আসবে মেসি-আলভারেজ জুটির কথা। মেসির পায়ে যখন বল এলো, তার সঙ্গেই ছিলেন মার্কার জস্কো গার্দিওল। চলতি আসরের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডারের তকমা পাওয়া গার্দিওল পারেননি মেসির পা থেকে বল কেড়ে নিতে। পায়ের সাথে বলকে আঠার মতো লাগিয়ে মেসি ড্রিবলিং করে এগিয়ে যান টাচলাইন ধরে। গোলপোস্টের সাথে দুরূহ কোণ থেকে যে মাইনাসটি করেন আর্জেন্টাইন এলএমটেন, তাতে প্লেসিং শটে লিভাকোভিচকে পরাস্ত করতে কোনো অসুবিধাই হয়নি আলভারেজের।

ফুটবল কখনও সুন্দর, কখনও নিষ্ঠুর। কোনো মহানায়কের কীর্তিতে যেখানে আড়ালে পড়ে যান অন্য কোনো নায়ক। লিওনেল মেসি বলেছিলেন, কাতার বিশ্বকাপই তার শেষ বিশ্বকাপ। আর সেই আসরের সেমিফাইনাল থেকেই যে বিদায় নিতে তিনি চান না, তা অনূদিত হচ্ছিল ম্যাচজুড়ে, আসরজুড়ে। সেই সাথে, জুলিয়ান আলভারেজের দুর্দান্ত পারফরমেন্সে নিশ্চিত হয়েছে মদ্রিচদের বিদায়।

২০১৮ বিশ্বকাপে নিজ দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন। চার বছর পর এমন এক স্কোয়াড নিয়ে খেলতে এসেছিলেন মদ্রিচ, যাদের কেউ আসর শুরুর আগে হিসেবের মধ্যেই রাখেনি। তবু শেষ চারে খেললো ক্রোয়েশিয়া। খেলালেন লুকা মদ্রিচ। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হাল না ছাড়ার মানসিকতায় আসর থেকে বিদায় করেছেন পরাক্রমশালী ব্রাজিলকেও। কিন্তু, অধিক দীপ্তিমান নক্ষত্রের কাছে যে হারিয়ে যেতে হলো মদ্রিচকেও! লিওনেল মেসি তাই সর্বোচ্চ পর্যায়েই জানান দিলেন, ‘আসল’ এলএমটেন’র বিতর্ক এখানেই শেষ।

/এম ই

Exit mobile version