Site icon Jamuna Television

শোনার অভ্যাস করুন, বদলাবে অনেক কিছু

রাশেদ রহমান:

গত বছর আমার মারাত্মক সাইকোলজিক্যাল ডিপ্রেশনের পর কলকাতার একটি হাসপাতালের একজন নন-ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের অধীনে বেশ কয়েকটি সেশন নিয়েছিলাম। শেষবার ওনার সাথে কথোপকথনে একটি কথা আমার মনে খুব লেগেছিল- বুঝলে রাসেদ (কোনো এক অদ্ভুত কারণে ভারতের ৭৫ শতাংশের বেশি পরিচিত মানুষ আমাকে রাসেদ/রাছেদ ডাকেন, রাশেদ নয়!) আমাদের কথা শোনার জন্য কেউ পাশে থাকে না, সবাই শুধু বলেই চলে যাবে। তুমি শোনার অভ্যেস করো।

এই কথা শোনা কি জ্ঞানের কথা শোনা? অবশ্যই না, এটা কারো ভেতরের ক্ষোভ, হতাশা, আক্ষেপ এবং অব্যক্ত ব্যাপারগুলো শোনা সরাসরি, কোনো জাজমেন্ট না দিয়ে। সেই সাইকোলজিস্টের দেয়া কিছু প্রশিক্ষণের পরে আমি কথা শোনা শুরু করলাম।

বলতে দ্বিধা নেই যে, গত ৪ মাসে আমি যাদের কথা শুনেছি (কিছু ক্ষেত্রে বলেছিও- এটা আমার অভ্যাস) তাদের মাঝে কয়েকজন সুইসাইড করি করি অবস্থায় ছিলেন, কেউ কেউ ‘ছ্যাকা’ খেয়ে মরি মরি করছিলেন, কেউ ‘ছ্যাকা’ কেন খাচ্ছি না ভেবে ডিপ্রেশনে ছিলেন, কেউ স্বজনের মৃত্যুর হতাশায় ডুবে ছিলেন, কেউ নিজের যৌন পরিচয় নিয়ে দুর্ভাবনায় ছিলেন, কেউবা নেশায় আসক্ত আর কেউ ‘আমার কী হবে’ ভাবতে ভাবতে খাবি খাচ্ছিলেন। সবার সাথে ঘণ্টা বা দিনব্যাপী কথা বা আলোচনা বা চ্যাটে আমি দেখেছি যে তাদের সবারই একটা সেইফ স্পেস দরকার বা একজন নিরপেক্ষ মানুষ দরকার যাকে তারা নিজেদের কথাগুলো বলতে পারেন কোনো দুর্ভাবনা ছাড়াই। যেখানে তারা জ্ঞানের কথা শোনার চেয়ে নিজেদের এক্সপ্রেস করতে পারবেন বেশি। যেখান থেকে তাদের প্যারাগুলোর ‘বাজ মার্কেটিং’ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করেছি, তাদের পাশে চুপচাপ বসে থাকা বা তাদের হাউমাউ করে কাঁদতে দেয়াও একটা বিশাল রিলিফ হয় তাদের জন্য। সবসময় আসলে কথা বলারও দরকার নেই।

এখন আসি, কেন আমি নিজের খেয়ে অন্যের ‘প্যারা’ নিচ্ছি? আমার খারাপ সময়ে আমি খেয়াল করেছিলাম, একাকিত্ব আমাদের প্রচণ্ড ভোগায়। তখন রাজ্যের সব অভিযোগ শোনানোর জন্যে কাউকে দরকার হয় যাকে আসলে বিশ্বাস করা যায় চোখ বুজে। আমি যেমন পেয়েছিলাম অনেকেই তা পান না। আর সেখান থেকেই মানুষের সাথে কথা বলা শুরু করেছিলাম, আর চ্যাট করাও। আবার প্রশ্ন আসতে পারে, সেসব মানুষেরা পড়াশোনা করা সাইকোলজিস্টের কাছে কেন যান না? জিজ্ঞেসা করে প্রধান যে কারণটি আমি খুঁজে পেয়েছি তা হলো- সহমর্মিতাবোধের অভাব। যেখানে অর্থ আর বাধা ধরা সময় থাকে, সেখানে সিমপ্যাথি থাকলেও এমপ্যাথি হয়তো ততটা থাকে না।

সেই সাথে, একজন হতাশাগ্রস্ত মানুষের সবকিছুকে আপনি নেগেটিভ ধারণা দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। মানুষ কতটা কষ্ট পেয়ে ডিপ্রেশনে যায় সেটা সহজেই অনুমান করা যায় না। ইমিউনিটির মতো সবার ইমোশনাল স্ট্যাটাসটাও আলাদা- একেকজনের একেক রকম। কারও কাছে না পৌঁছালে আপনি আসলে তাকে কখনোই সেভাবে সহযোগিতা করতে পারবেন না। এজন্য বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করাটাও জরুরি।

আমি যাদের কথা শুনি, তারা সবাই যে আমাকে পছন্দ করেন সেটাও হয়তো না; কিন্তু তারা ক্ষোভ, দুঃখ বা না পাওয়া ঝেড়ে ফেলার জন্য একটা স্কোপ পান সেটাও বা কম কিসের? গত ৩-৪ মাসে যারা ভালো আছেন, হাসছেন, পড়াশোনা করছেন, অফিস করছেন তাদের এই ভালো থাকাটাই আসলে সবচেয়ে বড় পাওয়া।

লেখক: মানবসম্পদ পেশাজীবী।

এটিএম/

Exit mobile version