Site icon Jamuna Television

রাজীব উৎসবে ‘হোক কলরব’

আল মাহফুজ

‘কুয়োর তলে ভীষণ জলে খাল না হয়ে ঝিল হলো ক্যান
ধুত্তরি ছাই মাছগুলো তাই ফুল না হয়ে চিল হলো ক্যান
হোক কলরব, ফুলগুলো সব লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান?’

এই শব্দরাজি প্রথম যখন কান থেকে মনের তানে ভেসে আসে, আমার মনে পড়ে গিয়েছিল বিনয় মজুমদার। মাছ, কুয়ো, সারস ইত্যাদি সাবজেক্ট ম্যাটার দিয়ে বিনয় মেটাফিজিক্যাল প্রগাঢ় কিছুর ইঙ্গিত দিতো। রাজীব আশরাফও হয়তো সেই পথের পথিক হয়ে যায়। তার ব্যবহার করা উপমা বা মেটাফোরগুলোর অর্থ দাঁড় করাতাম আমি নিজের মতো। আমার কাছে মনে হতো, সাদা-কালো আখর দিয়ে রাজীব হয়তো সজীব কিছু বুঝাতে চেয়েছে। কখনও মনে হতো, মানবজীবন সম্পর্কে আত্ম-জিজ্ঞাসার নির্যাস আছে তাতে। আবার কখনও প্রশ্ন জাগতো, এই গ্যালাক্সির কোথাও কি তা অস্তিত্বশীল?

ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অফ টেকনোলজি, কানপুরের প্রতিবাদ। ছবি: ফেইসবুক।


গান যখন আন্দোলনের হাতিয়ার

২০১৪ সালে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় ‘হোক কলরব’ আন্দোলন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনে এক ছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই অভিযোগের যথাযথ মর্যাদা দেয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর এই ঘটনার নিরপেক্ষ বিচারের দাবি নিয়ে ‘হোক কলরব’ স্লোগানে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা।

তিন দিন পর হঠাত মধ্যরাতে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ নেমে আসে। সংঘর্ষে গুরুতর জখম হয় ছাত্রছাত্রীরা। গণমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় তা সম্প্রচারিত হলে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। আন্দোলন বেগবান হয়। ঢেউ আছড়ে পড়ে ছাত্রসমাজে। দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু– নানা শহরে। ঢেউয়ের আঁচ লাগে দেশের বাইরেও। ‘হোক কলরব’ ছড়িয়ে যায় বিশ্বব্যাপী। রাজীবের লেখা এই শব্দবন্ধটি বনে যায় ছাত্র আন্দোলনের শাশ্বত স্লোগানে।

অখ্যাত রাজীবের কাছে অসংখ্য ফোনকল আসে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় লিরিকের নিহিতার্থ। রাজীব অগণিত ছাত্রছাত্রীর অনুভূতির গ্রাফিতিকে সম্মান জানায়। গানের অন্তরালের গল্প খোলাসা বা খোলতাই কিছুই করে না।

রাজীব আশরাফ (১৭ ডিসেম্বর ১৯৮২- ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩)

ফরমায়েশি লিরিক থেকে ‘কঠিন’ কবিতা

ফরমায়েশি লিরিক লিখতে রাজীব পছন্দ করতেন না। তার কবিতা থেকে তখন একের পর এক দুর্দান্ত সব গান বের হচ্ছে। সেসব গান কণ্ঠে ধারণ করছেন অর্ণব, আরাফাত মহসিন, পলবাসারা। কিন্তু আপাদমস্তক ‘কবি’ রাজীব ফরমায়েশি লেখা লিখতে চান না। তার চাই নিজের মতো করে কবিতা। যে কবিতা স্পেসিফিক একটি মোমেন্টে কেবল একজন পাঠকই পড়বে। পাঠক তার নিজের কল্পনায় উপমা, উৎপ্রেক্ষাগুলো নিয়ে ছবি আঁকবে। এই ভেবে রাজীব হলেন দৃঢ়সংকল্প। নিজের লেখায় সহজ বা নরম শব্দ উপেক্ষা করে গেলেন। তুলনামূলক কঠিন শব্দ দিয়ে কবিতা লেখা শুরু করলেন, যাতে কেউ সুর দিয়ে সেগুলোকে গানে রূপান্তরিত করতে না পারে। একদা পূরণ হলো তার স্বপ্নের কিয়দাংশ। প্রকাশিত হলো কবিতার বই ‘ধরেছি রহস্যাবৃত মহাকাল‘। রাজীব কি মহাকালের রহস্য শেষ পর্যন্ত ভেদ করতে পেরেছিলেন? নাকি নিজেই রহস্যের আবরণে মিশে গেলেন, যেভাবে উড়ে যায় পাখি ডানার অসুখে? ‘পুনর্জন্ম’ কবিতায় তার কিছুটা ইঙ্গিত দেন কবি–

‘ফেরারি চাঁদের মতো পৃথিবীতে এসে
স্মৃতিহীন পথিকের প্রতিটা পথই নতুন’

সময়ের আবর্তনে ‘আইসক্রিম’ সিনেমার ‘বোকা চাঁদ’ গানটি যেদিন শোনা হলো, মস্তিষ্কে শোরগোল তুললো– এই গান আলবত রাজীবের লেখা। অর্ণব যতোটা আদর দিয়ে গানটা কণ্ঠে তুলেছেন, তার চাইতে আরও আদর দিয়ে শব্দগুলো সাজিয়েছেন বোহেমিয়ান কবি। ওই গানের নিছক দুটো লাইন শুনেই আমার সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া– ‘বিবর বিশুষ্ক মায়ায়, নিশুন্য হাওয়ায় হাওয়ায়..’

নিমগ্ন রাজীব।


জাহাঙ্গীরনগরে রাজীব উৎসব

রাজীব আশরাফ কত বড় মাপের কবি ছিলেন, তা বিচার করবেন পাঠক। ‘গীতিকার’ ও ‘গীতিকবি’র মধ্যকার যে সূক্ষ্ম ফারাক, সেই আলোচনা গতি পাক অন্য কোনো দিন। আজ শুধু এতোটুকু বলতে চাই, রাজীব আশরাফরা কি পর্যাপ্ত স্পেস পান? গণমাধ্যম কি রাজীবদের কথা মনে রাখে? না রাখলেও হয়তো ক্ষতি নেই। কারণ, রাজীব হয়ে গেছেন অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সমার্থক শব্দ। রাজীবকে মনে রাখে এই শহরের অগুনতি মানুষ, শহরের কাঁধে যখন সন্ধ্যা ভর করে।

রাজীবকে মনে রাখে চারুকলা। মনে রাখে জাবির প্রাঙ্গণ। এই মায়েস্ত্রোর ৪১তম জন্মদিন উপলক্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি চত্বরে হচ্ছে ‘রাজীব উৎসব’। শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) দিনব্যাপী এই আয়োজনে থাকছে রাজীবের গল্প, কবিতা ও গান।

এই শিশির ভেজা শীতের সকালে আপনি চলে যেতে পারেন সেখানে। নরম রোদে মাখামাখি করে নিতে পারেন ‘আশরাফ’ গল্পের ভাগ। তার লেখা কবিতা বা গান আপনার মনে শান্তি বর্ষণ করুক। আপনি ছবি চত্বরের সিঁড়িতে বসে হয়তো রাজীবের দেখা পাবেন, হয়তো পাবেন না। কিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দুনিয়া অথবা এই মিথ্যে কথার শহর ছেড়ে আপনি একটু রাজীবের জন্য হাঁটুন। অতিক্রান্ত পথ খুব অচেনা মনে হবে না হয়তো..

Exit mobile version