Site icon Jamuna Television

সরকারি হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসার ‘ধোঁকা’, এখনও ব্যয়ের বেশিরভাগই দিতে হয় রোগীকে

রাসেল আহমেদ:

সরকারি হাসপাতালে ফ্রি পরীক্ষা ও ফ্রি ওষুধের কথা বলা হয়। তবে বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। রোগীর পকেট থেকেই এখনও যায় চিকিৎসা ব্যয়ের বেশিরভাগই। দরকারি ওষুধ আর দামি পরীক্ষার জন্য হাসপাতাল ছেড়ে যেতে হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তাই সরকারি হাসপাতালে ফ্রিতে কতটুকু সেবা মিলছে সে প্রশ্ন থাকছেই। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যখাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে দুর্নীতি বন্ধ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার পরামর্শ অভিজ্ঞদের।

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কথা হয় নোয়াখালীর আয়েশা বেগমের সাথে। বড় সন্তান শাহাদাতকে আইসিইউতে রেখে হাসপাতালের বারান্দায় থাকছেন তিনি। বেপরোয়া মোটরসাইকেলের আঘাতে মৃত্যুপথযাত্রী তার সন্তান। আরও দুই সরকারি হাসপাতাল ঘুরে পরে নিয়ে এসেছেন সোহরাওয়ার্দীতে। ১৭ দিনে চিকিৎসার জন্য তাদের পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে অন্তত চার লাখ টাকা।

আয়েশা বেগম বলেন, আমাদের ঘরভিটা ছাড়া কিছুই নেই। গ্রাম থেকে সবাই সাহায্য-সহযোগিতা তুলে পাঠাচ্ছে। এভাবেই চিকিৎসা করাচ্ছি। টাকা পাঠালেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।

তার এক স্বজন বলেন, আইসিইউয়ের বিল দিতে হয় না। ওষুধসহ সব কিছু বাইরে থেকে কিনতে হয়। প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হচ্ছে।

পায়ের রক্তনালীতে ব্লক নিয়ে অচল টাঙ্গাইলের গিয়াস উদ্দিনের ব্যথার তীব্রতা বাড়ায় তার ছেলে নিয়ে এসেছেন হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। ভর্তির সুযোগ মেলেনি তাই তিনদিন ধরে হাসপাতালের বারান্দায় ঠাঁই হয়েছে তার। রোগ যাচাইয়ে এবডোমিনাল এনজিওগ্রামসহ কয়েকটি পরীক্ষা দিয়েছেন চিকিৎসক। তবে সরকারি হাসপাতালে সেসব পরীক্ষা করা যায়নি। সেজন্য যেতে হয়েছে পাশের ডায়গনস্টিক সেন্টারে। আর এতে খরচ করতে হয়েছে ১২ হাজার টাকা।

গিয়াস উদ্দিনের ছেলে বলেন, তাদেরকে বলেছি স্যার আমি ছোট একটি চাকরি করি। আমাকেই সংসার চালাতে হয়। পরিবারের সবকিছুও আমাকে করতে হয়। তখন তারা বলেন- কিছু করার নেই। বাইরে থেকে করতে হবে, সবাই তাই করে। পরে বাইরে থেকে ১২ হাজার টাকায় করিয়েছি।

সেবাচিত্রের এমন চেহারা ওষুধের বেলায়ও। হাসপাতালে দেখা যায়, একজন রোগীর প্রেসক্রিপশনে তিনটি ওষুধ লেখা হয়েছে। তবে তারা হাসপাতাল থেকে ফ্রি ওষুধ পেয়েছেন মাত্র একটি। সেটির আবার পূর্ণাঙ্গ ডোজও দেয়া হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই বাকি ওষুধগুলো কিনে খেতে হচ্ছে পকেটের পয়সায়।

একজন রোগী বলেন, বলেছি কিছু ওষুধ দেন। বলে, এখানে ওষুধ নেই। বাইরে থেকে কিনে নেন। আরেক রোগী বলেন, ওষুধ চাওয়ায় পর তিনদিনের দিয়েছে। বাকিগুলো ফার্মেসি থেকে কিনতে হবে।

রোগীর পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। সরকারি হাসপাতালে কাগজে-কলমে প্রায় সবই পরীক্ষা করা যায়। তবে দীর্ঘ সিরিয়াল আর মেশিন নষ্টসহ নানা অজুহাতে সেসব বন্ধ থাকে বেশিরভাগ সময়। আর ওষুধের স্টক শেষ হয়ে গেছে খবর তো নিত্যদিনের! দিনশেষে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাটা পড়ে রোগী ও স্বজনদের পকেটই ।

এসব বিষয়ে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল ইনস্টিটিউট ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান মিলন বলেন, এখানকার সিটি এনজিওগ্রাম মেশিনটি নষ্ট আছে। ঠিক করার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন দেয়া হয়েছে। এটি ঠিক করতে অনেক টাকা খরচ হবে। তাই চিন্তাভাবনা চলছে- ঠিক করা হবে নাকি নতুন আরেকটি কেনা হবে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারবো। তিনি বলেন, মেশিনটি নষ্ট থাকার কারণে বেশি জরুরি হওয়ায় হয়তো কোনো রোগীকে বাইরে থেকে পরীক্ষা করাতে বলা হয়েছে।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফিউর রহমান বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশনসহ সবধরনের ওষুধের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে আমাদের। সরকারই এসব দিচ্ছে। শুধুমাত্র রোগীদের সেবার জন্য আনুষঙ্গিক কিছু কিনতে হয়।

সরকারি হিসেবে, দেশে রোগ নিরাময়ে রোগীর ব্যক্তিগত খরচ ৬০ ভাগের বেশি। ফ্রি চিকিৎসার নামে সরকারি অংশ এখনও মাত্র ২৩ শতাংশ। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রোগীর পকেট থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ব্যয় হওয়া উচিত।

রোগীর খরচ কমানোর বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজীর আহমেদ, সরকারি হাসপাতালে যতো রোগী আসবে সবার পরীক্ষা সেখানেই করতে হবে। তাহলেই রোগীর পকেটের টাকা বাঁচবে।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ওষুধের সরবরাহ বেশি থাকলে দুর্নীতির মাধ্যমে বিক্রির প্রবণতা বাড়তে পারে। ফলে দায়িত্বরতরা রোগীকে ওষুধ না দিয়ে নিজেরাই সেগুলো বাইরে বিক্রি করতে পারে কিংবা কমিশনের মাধ্যমে অন্য কাউকে দিয়ে থাকতে পারে। তাই আগে এসব বিষয়ের লাগাম টানতে হবে।

উল্লেখ্য, রোগীর মোট ব্যয়ের ৬৫ শতাংশই যায় ওষুধের পেছনে। বাকিটা যায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর চিকিৎসকের ভিজিটে।

/এনকে

Exit mobile version