Site icon Jamuna Television

নিজ গ্রামে শায়িত হলেন বীর প্রতীক তারামন বিবি

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
বীরপ্রতীক তারামন বিবির মরদেহ রাষ্ট্রীয়  মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন হয়েছে। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তার বাড়ি থেকে মরদেহ নিয়ে আসা হয় রাজিবপুর উপজেলা পরিষদ মাঠে। সেখানে দুপুর ২টায় তাকে রাজীবপুর থানার একদল পুলিশ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।

এরপর তার মরদেহে পুস্পস্তক অর্পণ করেন জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ সুপার মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। পরে জানাজা নামাজ শেষে উপজেলার কাচারী পাড়া শংকর মাধবপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে শায়িত করা হয়।

জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন, পুলিশ সুপার মেহেদুল করিম, সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলাম, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম টুকু, কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন, কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য রুহুল আমিন, সাবেক এমপি জাকির হোসেন, চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী বীর বিক্রম, রাজীবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান শফিউল আলম, সরকারি কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধাসহ আত্মীয়  স্বজন এবং বিপুল সংখ্যক গুণগ্রাহী ভক্তরা উপস্থিত হন। এসময় মিলাদ-দোয়া অনুষ্ঠানের জন্য সন্তানদের হাতে ৫০হাজার টাকা জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রদান করেন।


বীরপ্রতিক তারামন বিবি’র ছেলে আবু তাহের জানান, শুক্রবার গভীর রাত দেড় টার দিকে তার নিজ বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেন। বীর প্রতিক তারামন বিবি দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যু কালে তার বয়স হয়েছিল ৬২বছর। তিনি স্বামী, এক ছেলে,এক মেয়ে রেখে গেছেন।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম টুকু বলেন, বীরপ্রতিক তারামান বিবি জেলার গর্ব ছিলেন। আমি তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

বীরপ্রতিক আব্দুল হাই জানান, ১৯৭১সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বীরপ্রতিক তারামন বিবি’র অবদান ভোলার নয়। যুদ্ধ চলাকালীন সময় ধর্মের অযুহাতে নারীরা ঘর থেকে বের হবার সাহস পাননি। কিন্তু তারামন বিবি ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি শত বাধা অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা এবং কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে তার সাহসিকতার পরিচয় দেন। নতুন প্রজন্মের কাছে তার স্মৃতি ধরে রাখতে রাজিবপুর ও রৌমারী উপজেলাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা এবং তার নামে একটি বিশ্ব বিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানান।


মুক্তিযুদ্ধের দলীলাদি সংরক্ষণকারী অ্যাড. এসএম আব্রাহাম লিংকন পিপি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করলে বিশেষ করে ১১নং সেক্টরের ইতিহাস রচিত করতে গেলে স্বর্ণাক্ষরে বীরপ্রতিক তারামন বিবি’র নামটি লেখা থাকবে। যুগের পর যুগ ধরে রাখতে বীরপ্রতিক তারামন বিবি’র কুড়িগ্রামের হলোখানায় নির্মিত বাড়িটিকে একটি মুক্তিযুদ্ধ চর্চাখানা করার দাবি করেন তিনি।

জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য আকাশের উজ্জ্বল তারার মতই বীরপ্রতিক তারামন বিবি’র নামটিও মানুষের কাছে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে। তাকে স্বরণীয় করে রাখতে জেলাবাসীর দাবী গুলো তুলে ধরার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

উল্লেখ্য,বীরপ্রতিক তারামন বিবি কুড়িগ্রাম জেলার চর রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের কাচারী পাড়া শংকর মাধবপুর গ্রামে। বাবা আবদুস সোহবান এবং মা কুলসুম বিবি। বীরপ্রতিক তারামন বিবি ৪জন ভাই ও ২জন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৩য় সন্তান। স্বাধীনতা যুদ্ধের তাঁর একই এলাকার মৃত বরকত আলীর পুত্র আবদুল মজিদ’র সাথে বিয়ে হয় বীরপ্রতিক তারামন বিবি’র। তাঁদের এক ছেলে এক মেয়ে।

১৯৭১ সালে তারামন বিবি ১১ নং সেক্টরে নিজ গ্রামে। তখন ১১ নং সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। যিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার জন্য নিয়ে আসেন। তখন তারামনের বয়স ছিলো মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর। কিন্তু পরবর্তিতে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাঁকে অস্ত্র চালনা শেখান।

একদিন দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় তারামন ও তার সহযোদ্ধারা জানতে পারেন পাকবাহিনীর একটি গানবোট তাদের দিকে আসছে। তারামন তার সহযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অংশ নেন এবং তারা শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এরপর তারামন অনেক সম্মুখ যুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অংশ নেন।

অনেক বার তাদের ক্যাম্প পাকবাহিনী আক্রমণ করেছে, তবে ভাগ্যের জোরে তিনি প্রতিবার বেঁচে যান। যুদ্ধ শেষে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসীকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য “বীর প্রতীক” উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাঁকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের একজন গবেষক প্রথম তাঁকে খুঁজে বের করেন। নারী সংগঠন গুলো তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেই সময় তাকে নিয়ে পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার এক অনাড়ম্বর পরিবেশে আনুষ্ঠানিক ভাবে তারামন বিবিকে বীরত্বের পুরস্কার তাঁর হাতে তুলে দেন।

Exit mobile version