Site icon Jamuna Television

ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৭— আইনি দিক, কী ভাবছে ইসি, লাভ-ক্ষতি কার?

মিশুক নজিব

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, এ নিয়ে ধারণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্য দিয়ে সরকার ভোটের পথে হাঁটছে বলে মনে করছেন অনেকে। সরকারের পক্ষ থেকেও তা বলা হয়েছে। তারা বলছে, সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার পাশপাশি নির্বাচনের পথে হাঁটা হবে।

নয়া নির্বাচন কমিশন (ইসি) আজ খসড়া ভোটার তালিকাও প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে মোট ভোটার ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২ জন। ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫২ জন ভোটার বেড়েছে। ভোটার বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৫ শতাংশ।

দেশে এখন পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৩৩ লাখ ৩০ হাজার ১০৩ জন এবং নারী ভোটার ৬ কোটি ৩ লাখ ৫২ হাজার ৪১৫ জন। আর তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ৯৯৪ জন।

আগামী ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। এর আগে, ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ভোটার সংক্রান্ত দাবি ও আপত্তি জানানো যাবে। আর এ বিষয়ে শুনানি নিষ্পত্তির শেষ দিন আগামী ৩০ জানুয়ারি।

এখন দেশে ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৮। যাদের বয়স ১৮ হয়েছে, তারাই এ খসড়া ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন।

তবে, সম্প্রতি ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত এক সম্মেলনে ভোটারের বয়স নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া এক বক্তব্য নিয়ে আলোচনা ও বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘তরুণরা সংখ্যায় বেশি৷ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা আগ্রহী৷ নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মতামত নেয়ার জন্য আমি মনে করি ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত৷’

তবে যে কোনো সংস্কারের ব্যাপারে তিনি জাতীয় ও রাজনৈতিক ঐক্যমতের কথা বলেন৷ তার এ বক্তব্যের পরই আলোচনার সূত্রপাত।

ইসির ভাবনা

খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর রাজধানীর নির্বাচন ভবনে ইসি সচিব আবুল ফজল মোহাম্মদ সানাউল্লাহ বলেন, ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৭ বছরের বিষয়ে আলোচনা চলছে। ভবিষ্যতে যদি রাজনৈতিক ঐক্যমত হয় এবং তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলে সেটা বিবেচনা করা হবে।

এছাড়া, চলতি বছরে ভোটার হালনাগাদে যাদের তথ্য নেয়া হবে, তাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করার কথা আগামী বছরের মার্চে। এর মধ্যে যদি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে তারা ভোট দিতে পারবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মোহাম্মদ সানাউল্লাহ বলেছেন, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেয়া হবে।

ভোটারের সর্বনিম্ন বয়সের বিষয়ে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিনও দেখালেন সংবিধান। গত ৩০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, সংবিধানে ১৮ বছরের কথা বলা আছে। সংবিধান সংশোধন করে ১৭ বছর করা হলে আমরা সেই অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেব। 

আইনি দিক

ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স পুনর্নির্ধারণে আইনি তাৎপর্য রয়েছে। দেশের শিশু আইন অনুযায়ী, ‘অনূর্ধ্ব–১৮ (আঠারো) বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসাবে গণ্য হইবে।’

জাতিসংঘের মতে, ‘জাতীয় আইনে যদি অন্য কিছু না থাকে, তাহলে ১৮ বছর বয়সের কম যে কোনো মানবসন্তানই শিশু’। আমাদের শিশুনীতি-২০১১ অনুযায়ী, ‘১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা কিশোর-কিশোরী গণ্য হবে’।

শিশুকালীন নির্ভরতা থেকে একজন স্বনির্ভর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষে পরিণত হতে যে ক্রান্তিকালটা পার হতে হয়, সেই সময়ের নামই হলো কৈশোর।

দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, এই শিশুরা যদি কোনো বিশেষ অপরাধেও জড়িত থাকে, তাহলে সেই সব অপরাধের অনুসন্ধান, তদন্ত আলাদাভাবে করার এবং বিচারকার্যও শিশু আদালতে করার বিধান রয়েছে।

১৭ বছরের শিশু-কিশোরদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার মানে হলো রাষ্ট্রীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে তাদের মতামত দেয়ার স্বীকৃতি দেয়া। যদি ১৭ বছর বয়সেই এই সক্ষমতা অর্জিত হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের ১৭ বছরের কিশোরীদের বিয়ের বন্দোবস্ত করাটাও বৈধ বলে ঘোষণা করতে হবে। বর্তমানে বলবৎ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে বিবাহ দণ্ডনীয় অপরাধ।

এখন প্রশ্ন, ১৮ বছর বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত দেশের বিদ্যমান অন্যান্য আইন সংশোধন না করে কি ভোটার হওয়ার বয়স পুনর্নির্ধারণ করা হবে? নাকি ভোটার হওয়ার জন্য সংবিধান সংশোধনের মতো এসব আইনেও সংশোধনী আনা হবে?

১৭ হলে নতুন ভোটার হতে পারেন কত

ভোটার তালিকা আইন অনুযায়ী, প্রতিবছর ২ জানুয়ারি থেকে আগামী ২ মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়। ২ জানুয়ারি আগের বছরের তথ্য নিয়ে হালনাগাদ ভোটার তালিকার খসড়া প্রকাশ করে ইসি। তালিকা নিয়ে দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে ২ মার্চ প্রকাশ করা হয় চূড়ান্ত তালিকা।

ভোটারের বয়স কমপক্ষে ১৭ করা হলে কত সংখ্যক ভোটার বাড়বে এর নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে, ইসির পূর্ববর্তী ভোটার তালিকা থেকে একটা অনুমান পাওয়া যেতে পারে।

পঁচিশের শুরুতে প্রকাশিত খসড়া তালিকায় ভোটার ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২ জন। তাতে বছরের ব্যবধানে এবার ভোটার বাড়ছে ১৮ লাখের বেশি।

গত বছর ২০২৪ এর মার্চে চূড়ান্ত তালিকায় ভোটারের সংখ্যা ছিল ১২ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ১৬০ জন।

তেইশের চূড়ান্ত তালিকায় ভোটার ছিল ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৯৩৭। তারাই চব্বিশের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পান।

তাতে দেখা যাচ্ছে, তেইশ থেকে চব্বিশ— এক বছরের ব্যবধানে ভোটার বৃদ্ধি পেয়েছে সাড়ে ২১ লাখের বেশি। শেষ একটি খসড়া ও দুইটি চূড়ান্ত ভোটার তালিকা থেকে বোঝা যায়, প্রায় ২০ লাখের মতো ভোটার যুক্ত হচ্ছেন নতুন করে।

এবার জাতীয় নির্বাচনে ভোটারের একটা হিসাব দেখা যাক। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিল ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১। পাঁচ বছর পরে দ্বাদশে গিয়ে ভোটার বৃদ্ধি পায় এক কোটি ৫৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৫৬-তে৷ সে হিসেবে বছরে গড়ে ভোটার বৃদ্ধি পেয়েছে ৩১ লাখের বেশি।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভোটারের বয়স ১৭ নির্ধারণ করলে ২০ থেকে ৩০ লাখের মতো মানুষ ভোটার হওয়ার যোগ্য হবেন।

আর যদি ভোটারের ন্যূনতম বয়স ১৭ না করে, তবে ২০২৬ সালের মার্চের আগে ভোট হলো এবং চলতি বছরে হালনাগাদ শুরু হওয়ার পর যারা ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হবেন, তাদের ক্ষেত্রে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আগেভাগেই চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হলে ভোটার বাড়তে পারে আরও ২০ থেকে ৩০ লাখ। তাতে দ্বাদশ থেকে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য ভোটার বৃদ্ধি পেতে পারে ৪০ থেকে ৫০ লাখ। এর পাশাপাশি সংবিধান সংশোধন করে ভোটারের ন্যূনতম বয়স ১৭ করলে এবং আগামী বছর ভোট হলে নতুন ভোটার হতে পারে ৬০ লাখ থেকে কোটির কাছাকাছি।

ভোটের মাঠে লাভ-ক্ষতি, রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া

ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান হওয়ায় নতুন ভোটার এবং ১৭ বছর বয়সীদেরও ভোটদানের সুযোগ দিলে তাদের কত সংখ্যক দেশের বিদ্যমান বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট দেবে, এমন একটি হিসাব–নিকাশ থাকা স্বাভাবিক।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররাও চায় ভোটারের ন্যূনতম বয়স ১৭ হোক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক লুৎফর রহমান যমুনা নিউজকে বলেন, ভোটারের বয়স ১৭ হওয়া নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা যে বক্তব্য দিয়েছেন এবং এ নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে ইসি জানিয়েছে— এটিকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। কারণ, তরুণরা জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিজেদের রাজনৈতিক ম্যাচিউরিটির প্রমাণ দিয়েছে। গত সাড়ে ১৬ বছরে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সেভাবে লড়তে পারেনি। তরুণ ছাত্ররাই ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন ঘটিয়েছে।

ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স ১৭ করা হলে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে তরুণরা অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাবে, এটিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

এদিকে, প্রধান উপদেষ্টার কথার পরই এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা সরকারের প্রধান নির্বাহী, তিনি বলে দিচ্ছেন ১৭ বছর হলে ভালো৷ যদি এক বছর কমাতে চান, তাহলে সেটা নির্বাচন কমিশন প্রস্তাব করুক৷ প্রধান উপদেষ্টা যখন বলে দেন, তখন চাপ তৈরি হয় নির্বাচন কমিশনের জন্য৷

তার মতে, ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ নাকি ১৮ হবে তা নির্ধারণের কাজ ইসির। 

ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ করার পক্ষে জামায়াত। দলটির আমির শফিকুর রহমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি এই দাবি জানিয়েছেনও।

যেসব দেশে ১৮-এর কম বয়সীরা ভোট দিতে পারে

চাইল্ড রাইটস ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক ও ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ এর তথ্য অনুযায়ী, ১৬ বছর হলেই ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, কিউবা, ডমিনিকান রিপাবলিক (বিবাহিত), ইকুয়েডর, এস্তোনিয়া (স্থানীয় নির্বাচন), জার্মানি (কিছু স্থানীয় ও স্টেট নির্বাচন), হাঙ্গেরি (বিবাহিত), মাল্টা (স্থানীয় নির্বাচন), নিকারাগুয়া, স্লোভেনিয়া (চাকরিজীবী), অস্ট্রিয়ায় ভোট দেয়া যায়।

ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড ও ওয়েলসে ভোটের বয়স ১৮৷ তবে স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে প্রাদেশিক ও স্থানীয় নির্বাচনে ১৬ বছর বয়সীরা ভোট দিতে পারে৷

গ্রিস, ইন্দোনেশিয়া, ইসরায়েল (স্থানীয় নির্বাচন), উত্তর কোরিয়া ও পূর্ব তিমুরে ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর৷

/এমএন

Exit mobile version