মাহমুদ সানা
ফেব্রুয়ারি মাসের আলাদা মহত্ত্ব আছে, অনেকগুলো কারণে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন তারই একটা বড় কারণ। বায়ান্ন স্রেফ ভাষার জন্য আন্দোলন নয় বরং কালচারাল বিকাশের অংশ। ফলে বায়ান্নর আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের জন্য আমাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে যে গতি তৈরি হয়েছে, তারই অংশ আমাদের পরবর্তী মুক্তি।
শীতের শেষাংশ হিসেবে ফেব্রুয়ারি দারুণ আবহাওয়ার বাতাবরণ দেয়। হীম হয়ে ওঠা শরীরে সামান্য উষ্ণতা দেয়। আবির্ভাব হয় বসন্তের। ফুরফুরে হাওয়ায় ভাসতে থাকে নগর। পাতা ঝরতে থাকে গাছের। নতুন পাতা জন্মাতে থাকে। পাখি, পুষ্পে, প্রকৃতিতে অনন্য সুন্দরের আগমন হয়। ফোটে পলাশ, কৃষ্ণচূড়া আর শুরু হয় বইমেলা।
বিভাগীয় শহরে মেলাকেন্দ্রিক আমাদের যে আমোদ-আহ্লাদ, সেটা চমত্কার ব্যাপার। পড়ুয়া ও লেখিয়েদের যে সমাগম হয়, তা আনন্দদায়ক বটে কিন্তু একইসঙ্গে হতাশারও। মেলায় থাকে প্রকাশনা, বই বিক্রি, অর্থকড়ি সংক্রান্ত বিষয়াদি। মেলার সময়টাতে চলে বইয়ের আলোচনা-সমালোচনা। পড়ুয়ারা হিসেব মেলায় বইয়ের প্রচ্ছদ, লেখা-লেখক, শিরোনামের সঙ্গে প্রচ্ছদের দ্বন্দ্ব-মিমাংসা। এতো কিছুর মাঝেও রয়েছে আনন্দ, সুখ। আরও আছে আকাঙ্ক্ষা।
‘২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষ তার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে চায়। কারণ, এতো বছর ধরে ফ্যাসিবাদের ভুত চেপে বসেছিল রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকি পরিবারবর্গের মধ্যেও। ফলে লড়াইটা সামগ্রিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেই ছিল। ধরা যাক তুষার একজন যুবক। সাদিয়ার প্রেমে সারাবছর সে বুকের মধ্যে বসন্ত নিয়ে ঘুরছে। সেই সাদিয়ার স্কুল, কোচিং, বাড়ি এমনকি তার চলাচলের ত্রিসীমানায় তুষারের প্রবেশ নিষেধ। এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ফ্যাসিস্টের লোক। ধরা যাক বিরোধী পার্টির একজন নেতা, মিথ্যা মামলায় যার জীবন জেরবার। ফলে তুষার ও ওই নেতা, দুজনই ফ্যাসিস্টের বিপক্ষে লড়েছেন। তাদের আকাঙ্ক্ষা ভিন্ন। একজনের আকাঙ্ক্ষা গণতান্ত্রিকভাবে ভালোবাসার, অন্যজনের গণতান্ত্রিকভাবে পার্টি-রাজনীতি করার। এভাবে দেশের বিভিন্ন বর্গের নাগরিকের সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষাও রয়েছে। আবার নতুন ভাবনার উপস্থিতিও ঘটতে পারে। ফলে বইমেলা পড়ুয়া ও লেখিয়েদের আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে।

বইমেলা শুরুর ইতিহাস স্বাধীনতার পরের বছর। দিনে দিনে মেলার পরিসর বেড়েছে। আমার শহরের বইমেলার প্রধান ফটকে রঙিন আলোর ঝলকানি থাকে। দূর থেকে চমক দেখতে পাওয়া যায়। ভেতরে একটা মঞ্চ থাকে। সেখানে হয় আবৃত্তি, গান, নাচ। আছে বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের আয়োজন। এতো এতো বইয়ের দোকান আর মানুষের ভিড়। পড়ুয়ারা নতুন বইয়ের গন্ধ নিতে মেলায় আসে। রয়েছে খাবারের দোকানও। তার উল্টো দিকে আড্ডা জমান লেখকরা।
মেলা চলতে থাকে। রাত বাড়তে থাকে। আড্ডা ভাঙে, লেখক-পাঠক বাড়ি ফেরে। ২০১৫ সালে এমনই এক বইমেলায় আমি আর আমার বন্ধু বাড়ি ফিরব বলে হাঁটতে শুরু করলাম। অকস্মাৎ বিকট শব্দ শুনে পিলে চমকে গেছিল! মেলার প্রধান ফটকে গিয়ে বুঝতে পারি– সেটা ছিল পেট্রোল বোমা। আমরা মনে মনে এক দোকানিকে ধন্যবাদ জানালাম। কারণ, সেই দোকানি না ডাকলে আমরা হয়তো বোমার মুখেই পড়তাম। যাহোক, এরকম বই মেলা আমরা চাই না। সবার জন্য নিরাপদ একটা বইমেলা হোক, এটাও চাওয়া।
ইদানিং শহরে বা অন্য মেলাগুলোতে বইয়ের দোকান চোখে পড়ে না। দ্রুত গতিতে শপিং মল গজিয়ে উঠছে। সেখানেও থাকুক বই বিতান। বই কিনলে কেউ দেউলিয়া হয় না। বই সংগ্রহে রাখা যায়। কোনো কোনো বই বারবার পড়া যায়।
বইমেলা এলে বই নিয়ে বিজ্ঞাপন বাড়ে। পত্রপত্রিকায় বা অনলাইনে লেখিয়েদের আলাপ জমে বই বিষয়ে। এই অনুষঙ্গে বইমেলা মানুষের আরও আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে মেলা ক্রমশ বাড়তে থাকুক এবং বই পড়ার মাধ্যমে মানুষের মনের বিকাশ হোক। পাঠক-লেখক-প্রকাশক এগিয়ে যাক আনন্দ, সুখ আর নিজস্ব আকাঙ্ক্ষার দিকে।
/এএম
Leave a reply