Site icon Jamuna Television

নির্বাকের পাশে: বহুদিন পর গল্পের নিটোল স্বাদ

মধ্য গগনে অমর একুশে বইমেলা। বাঙালির এই প্রাণের মেলায় পাঠক ও লেখককে একসূত্রে গাঁথতে যমুনা টেলিভিশনের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে থাকছে বই নিয়ে বিশেষ আয়োজন। সেই ধারাবাহিকতায় থাকছে বইমেলায় প্রকাশিত নতুন-পুরোনো বইয়ের রিভিউ বা পাঠকের প্রতিক্রিয়া।

আজ থাকছে ২০২৪ বইমেলায় প্রকাশিত লেখক মোজাহিদুল ইসলামের বই ‘নির্বাকের পাশে’ নিয়ে আলোচনা। লিখেছেন মারুফ ইসলাম

একেক পাঠকের একেক রকম চাওয়া থাকে। একজন গল্পের পাঠক হিসেবে আমি লেখকের কাছে কী চাই? আমি চাই, একটা পোক্ত গল্প। কিন্তু বোধহয় আমারই দুর্ভাগ্য যে, এখনকার ফিকশন রাইটারদের বইয়ে আমি কোনো ‘গল্প’ খুঁজে পাই না।

গল্পটা যে মারমার-কাটকাট হতে হবে, জরুরি নয়। সাসপেন্স, থ্রিলারে ভরপুর থাকতে হবে, এমনটাও অবশ্যপালনীয় নয়। একটা সহজ-সরল নিস্তরঙ্গ বয়ে যাওয়া জীবনের গল্প হলেও চলে। কিন্তু কী এক দুর্ভাগা সময় যে পার করছি! অনেক আশা নিয়ে যেসব বই পড়তে শুরু করি, শেষ পর্যন্ত দেখা যায়– সেই বইয়ে কোনো গল্প নেই। গড়গড় করে পড়া যায় কিন্তু কাহিনীর সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করা যায় না।

তবে বহুদিন বাদে পড়লাম তরুণ গল্পকার মোজাহিদুল ইসলামের ‘নির্বাকের পাশে’ বইটি। পড়ার পর মনে হলো– পৃথিবীর সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও কোথাও না কোথাও একটা ভাঙাচোরা জানালা ঠিকই খোলা থাকে; যে দিক দিয়ে এক চিলতে আলো আসে, যে দিক দিয়ে বন্ধ ঘরের ভ্যাপসা গন্ধ আর গুমোট হাওয়া বের হয়ে যায়।

আগেই বলেছি, পাঠক শেষ পর্যন্ত একটা নিটোল গল্পই চায়। চায় নতুনত্ব বা আলাদা কিছু, যা এই সোশ্যাল মিডিয়ার হাঙর-সময়ে রিলস বা শর্টসে নেই। মোজাহিদুল সেই কাজ বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে করতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি। তিনি জীবনানন্দের মতো ‘ক্রমশ একা আলাদা’ হতে হতে সময়ের মধ্যে থেকেও আলাদা সময় দেখিয়েছেন, জীবনের মধ্যে থেকেও দেখিয়েছেন আলাদা জীবন। আমরা তাই মোজাহিদুলের গল্পে অসংখ্য অন্তর্দৃষ্টি দেখতে পাই। একটি বড় গল্পের মধ্যে ছোট ছোট আরও অনেক গল্প পাই। তারপরও বিচ্ছিন্নতা বোধ করি না বরং গল্প শেষে সব মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি গল্পই পাই।

‘নির্বাকের পাশে’ বইয়ের প্রচ্ছদ

আমরা ‘নির্বাকের পাশে’তে দেখতে পাই– মিছিলের ভিড়ে নারীর শরীরে হাত দিচ্ছে ‘সোনার ছেলেরা’। আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক সংস্কার, ধর্মীয় সংস্কার, সমকামিতা, রাজনৈতিক বাস্তবতা, একাকী মানুষের অসহায়ত্ব ইত্যাদি নানা বিষয় উঠে এসেছে এই বইয়ের গল্পগুলোতে।

ছোটগল্পের ছোট্ট পরিসরে বড়জোর দুহাজার শব্দ, এর মধ্যে এতো এতো জটিল বিষয় ‘ডিল’ করা চাট্টিখানি কথা নয়। লেখক সেই কাজ বেশ মুন্সিয়ানার সঙ্গে করেছেন। আবার সব মিলিয়ে একটা আস্ত গল্পের স্বাদও দিয়েছেন। তারপরও কিছু গল্পে মনে হলো, তিনি বেশ তাড়াহুড়ো করেছেন। গল্প শেষ করার একটা তাড়না ছিল মনে হয়। তাই মরিয়া হয়ে গল্পটার একটা পরিণতি দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ফলে যেটা হয়েছে– গল্পটা প্রাণ হারিয়েছে।

আবার কিছু গল্পে দেখা গেছে– গল্পটা মাত্রই ডালপালা মেলতে শুরু করেছে, শিকড় ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে গভীরে, আর অল্প সময়ের মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়াবে আকাশে; ঠিক তখনই গল্পটা থামিয়ে দিয়েছেন মোজাহিদুল। এমন বেশ কয়েকটি সম্ভাবনাময় গল্পের অপমৃত্যু পাঠক হিসেবে আমার চোখে পড়লো।

চরিত্রের বুকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করাই একজন লেখকের সবচেয়ে বড় সার্থকতা। উদাহরণ হিসেবে শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পের কথা বলতে পারি। গল্প শেষ করার পর সামান্য একটা গরুর জন্য আমাদের প্রাণ কেঁদে ওঠে। কারণ, মহেশ নামের চরিত্রটিতে শরৎচন্দ্র প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু মোজাহিদুলের কিছু কিছু গল্পের দুই-একটি চরিত্র মনে হলো নিস্প্রাণ। ছায়াবাজি পুতুলের মতো ‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচি’ স্টাইলে নেচে গেছে বটে, তবে তাদের বুকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি লেখক।

তারপরও ‘ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে’ বলে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যে আক্ষেপ একদিন করেছিলেন, সেই আক্ষেপ মোজাহিদুল ইসলামের হাত দিয়ে ঘুচতে যাচ্ছে– এমন আশা আমি বেঁধে রাখতে চাইছি। আশা করি, এই তরুণ লেখক তার পরবর্তী বইয়ে আমাদের আশাহত করবেন না।

/এএম

Exit mobile version