এক্সিস্টেন্সের যাত্রায় প্রতিনিয়ত নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চান তিনি। তার এই আবিষ্কারের নেশার প্রধান ফাইন্ডিংস দ্বন্দ্বের স্বাক্ষর। এক্সিস্টেন্স সবসময় দ্বন্দ্বের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করে নাকি দ্বন্দ্ব নিজেই নেমে আসে এক্সিস্টেন্সের কাছে, তা জানতেই মুখোমুখি লেখক-চিন্তক শরিফুল ইসলামের। লেখকের সঙ্গে কথা বলেছেন আল মাহফুজ ও মুনিম রাব্বি।
যমুনা ওয়েব: কেমন আছেন?
শরিফুল ইসলাম: কেমন আছি, এইটার উত্তর খুব সহজে দেওয়া যায়। নরমালি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে আমরা পজিটিভ ইম্প্লিকেশন ফিল করি যে বলতেই হবে, ভালো আছি। খুব বেশি ঘনিষ্ঠ কেউ হলে আমরা নরমালি বলতে চাই না– আমি আসলে ভালো নাই। নেগেটিভ জিনিসটা বলতে চাই না। এর কারণ হলো, ভালো নাই বললে এটার একটা এক্সপ্লেনেশন দিতে হয়। সেই জায়গা থেকে যদি বলি, আমি কেমন আছি; ভালো আর খারাপ এই দুইটা স্টেপকেই আমি ফ্লিপিং অনুভূতি হিসেবে দেখি। মানে যেটা কখনোই পার্মানেন্ট না। যখন আমি বলব– ভালো আছি, এটা স্প্লিট সেকেন্ড পরেই কোনো একটা কারণে চেঞ্জ হয়ে যেতে পারে। তো আমি আসলে আছি। আমি এক্সিস্ট করি। রেনে দেকার্তের বলেছেন— ‘আমি চিন্তা করি, তার মানে আমি আছি।’ অস্তিত্বশীল জায়গা থেকে বললে, আমি আছি কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসে– চিন্তা না করলে কি আমার এক্সিস্ট্যান্ট নাই হয়ে যায়? ওইটাও আবার আরেকটা প্রশ্ন।
এই কারণে আমার একটা ফিলোসফিক্যাল অ্যানসার থাকে– আমার থাকা ও না থাকার ক্ষেত্রে আমি আছি এবং অ্যাট দ্য সেম টাইম আমি নাই-ও।
যমুনা ওয়েব: আপনার কাছে তাহলে ভালো থাকা বা খারাপ থাকা মুখ্য বিষয় না। এটা কি এক্সিস্টেন্ট অথবা নন-এক্সিস্টেন্ট?
শরিফুল ইসলাম: এটা মুখ্য, আবার মুখ্যও না। এক্সিস্টেন্সে আমাদের সবারই ফিজিক্যালি একটা ফর্ম আছে। আমার শারীরিক কিছু কন্ডিশন আছে, মেন্টাল কিছু কন্ডিশন আছে। যেগুলো প্রায় ৯০% ক্ষেত্রে যদি আমাদের স্টেটের সাথে সিংক্রোনাইজড না হয়, তখন আমরা নানা ধরনের পীড়া অনুভব করি। ওই অনুভবটা যদি আমাকে কন্সট্যান্টলি বদার করতে থাকে, ওই স্টেপটা থাকলে আমি বলতে পারি, আমি আসলে ভালো নাই। আর মোটামুটি আমি যদি কমফোর্টেবল অবস্থায় থাকি, তার মানে আমি ভালো আছি এই মুহূর্তে বা ওই অবস্থায়। আর ভালো থাকা না থাকা আমার কাছে এক্সিস্টেনশিয়ালি ম্যাটার করে নাকি ফিজিক্যাল ফর্মে ম্যাটার করে, এটাও একটা প্রশ্ন। ওই এক্সটেনশন থেকে বলা যায়, আমাকে একটা বিশাল অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জিনিসটাকে অবজার্ভ করা দরকার এবং সেটা আমি করি।
যমুনা ওয়েব: এই রিয়ালিটি বা এক্সিস্টেন্সের সাথে আপনার সংশ্লিষ্টতা বা ব্যক্তিক কোনো সামঞ্জস্যতা প্রথম কবে টের পেলেন?
শরিফুল ইসলাম: আমাদের লাইফের প্রাথমিক ফিলোসফি থাকে, আমরা যে রেলিজিয়ন নিয়ে বড় হই, ওইটাই মোটামুটি আমাদের লাইফকে ড্রাইভ দেয় যে– আমাদের কোন দিকে যাওয়া উচিত আর কোন দিকে যাওয়া উচিত না। তারপর কেউ যখন এক্সিস্টেনশিয়াল এক্সপ্লোর করে, তখন তার চিন্তার ডালপালা ছড়ায়। তো আমি যখন দেখলাম, আমাকে আসলে যে এক্সপ্লেনেশন দেয়া হয়েছে ছোটবেলা থেকে, সেই এক্সপ্লেনেশনে জগত সংসারের মিস্ট্রি বোঝাটা আমার জন্য এনাফ ছিল না। তখন আমি এটাকে প্রশ্ন করা শুরু করি। আমি ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছি। সাহিত্য যেহেতু ফিলোসোফির সাথে রিলেটেড, তখন আমার মধ্যে একটা ফিলোসফিক্যাল টাচ আসে। সেটা আমাকে ট্রিগার করে– এক্সিস্টেনশিয়ালি আমি কে, আমি কী, আমি কেন? এই রিয়ালিটি কেন কীভাবে চলছে? এই রিয়ালিটির মধ্যে যে সবকিছুর একটা ইন্টারকানেকশন রয়েছে, আমি অনুসন্ধান করা শুরু করি। তখন থেকে আমার মধ্যে এক্সিস্টেনশিয়াল কোয়েস্টের ট্রেন চালু হয়, এখান থেকে একটা যাত্রা শুরু হয়ে যায়।

যমুনা ওয়েব: জগত বা পৃথিবী নিয়ে মৌলিক কিছু প্রশ্ন আসে আমাদের মনে। অনেক সময়ই আমাদের উল্টারথে চলতে হয়। আপনি যেটা বলছিলেন.. আপনাকে বোঝানো হয়েছে, যে ড্রাইভ আপনি পেয়েছেন, তার বিপরীত দিকেও আপনাকে যেতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সমাজ বা পরিবার থেকে অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। আপনার ক্ষেত্রে এরকম কিছু হয়েছে কিনা?
শরিফুল ইসলাম: হ্যাঁ। এমন এক সেটআপে আমি বড় হয়েছি, সবাইকে যেটা দেয়া হয়, নরমালি তা দিয়ে মানুষ চলে। তো যখন আমি আমার সেটআপে প্রশ্ন করা শুরু করলাম, জিনিসটাতে তখন ধাক্কা লাগলো। এতে চ্যালেঞ্জ যেটা হয়, সেটা হলো সারাউন্ডের সাথে অটোমেটিকালি ডিসকানেকশন তৈরি হয়ে যায়। পুরাতন বন্ধুবান্ধব, পরিবার আস্তে আস্তে সরে যায়। যে গ্রুপে আমরা বড় হই, সেই গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হয় হয়। মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায় এটাকে। এবং চিন্তার প্রসার ঘটাতে গেলে এই ঘটনা সর্বপ্রথম ঘটে। বেশিরভাগ মানুষই এ কারণে এই জার্নিতে পা দিতে চায় না। আমি পা দিয়েছিলাম। এর কারণ হলো, এইটা না করে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না।
যমুনা ওয়েব: তার মানে গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় নিয়েই আপনি এই প্রশ্ন করা শুরু করলেন। প্রিয়জনদের বিচ্ছেদ আপনার কাছে তাহলে মুখ্য হয়ে ওঠে নাই?
শরিফুল ইসলাম: না। এটা মুখ্য খুব একটা হয় নাই। এর কারণ হলো প্রাইমারি লেভেলে যাদের সঙ্গে ব্লাড রিলেশন, তারা এই চিন্তার জন্য কখনোই ছেড়ে যাবে না। আবার অনেক সময় হয় কি, তারা জানতেও পারে না। যার কারণে এটা নিয়ে আমার ভয় লাগে না, তারা থাকবেই। যে সার্কেলটা (বন্ধু) আমাদের বেড়ে ওঠার সাথে থাকে, তাদের নিয়েও আমার খুব বেশি ভয় ছিল না।
যমুনা ওয়েব: বন্ধু নিয়ে একটা জিজ্ঞাসা আছে। আমরা যারা ফিলোসফির সাথে পরিচিত না, তারাও অনেক কিছু নিয়ে প্রায় সময়ই দ্বন্দ্বে ভুগে থাকি। ফিলোসফিতে দ্বন্দ্ব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটাকে আপনি কোন এ্যাঙ্গেলে দেখেন? দ্বন্দ্বটা আমাদের জীবনে আসলে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ?
শরিফুল ইসলাম: এটা খুবই চমৎকার একটা প্রশ্ন। এক্সিস্টেন্স এক্সপ্লোরেশন করে আমি যে জিনিসটা পেয়েছি, এর মধ্যে মেইন ফাইন্ডিংস হলো এক্সিস্টেন্স সবসময় কনফ্লিক্ট নির্ভর। এখানে সবকিছুতেই দ্বন্দ্ব আছে। এটাকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তার ‘পার্থিব’ বইয়ে বলেছিলেন ‘টানাপড়েন’। দ্বন্দ্ব থেকে অনেক সময় টানাপড়েন আসে। টানাপড়েনের গুরুত্ব কতোটুকু, এটা শীর্ষেন্দুর কথা ধরে বোঝাতে চাই। আমরা যখন কাঁথা সেলাই করি, সেলাইটা মূলত কাপড়ের সাথে সুতার একটা দ্বন্দ্ব। দুইটার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব হচ্ছে, এই দ্বন্দে একটা অ্যাটাচমেন্ট তৈরি হয়। ওই অ্যাটাচমেন্টটাই সেলাই। আমরা যদি দড়ি বা কোনো কিছুতে গিঁট দেই, সেটা কিন্তু একটাকে আরেকটার সাথে দ্বন্দ্ব করেই..
যমুনা ওয়েব: আপনি বলতে চাচ্ছেন, দ্বন্দ্ব থেকে অ্যাটাচমেন্টটা আসে?
শরিফুল ইসলাম: না, আমি বললাম, দ্বন্দ্ব হলো এক্সিস্টেন্সের মূল এলিমেন্ট। দ্বন্দ্ব ছাড়া, ক্রাইসিস ছাড়া এক্সিস্টেন্স সারভাইভ করতে পারে না। আমরা দেখি, ব্যাটারিতে নেগেটিভ ও পজেটিভ দুইটা লাইন থাকে। মোটামুটি এক্সিস্টেন্সের মূল কাঠামোটাই হল দ্বন্দ্ব। আর চিন্তার দ্বন্দ্বই হলো ফিলোসফিক্যাল দ্বন্দ্ব। যে যতো বেশি দ্বন্দ্ব রিসিভ করতে পারবে, সে ততো কিক-স্টার্ট হিসেবে দ্বন্দ্বকে সাথে করে সামনের দিকে আগাইতে পারবে। যেমন পেছনের দিকের ধোঁয়াটা রকেটকে সামনের দিকে পুশ করে। দ্বন্দ্ব হলো চিন্তা ও এক্সিস্টেন্সের মূল সোর্স।
যমুনা ওয়েব: যমুনাতে আসা নিয়ে আপনার মনে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল কিনা?
শরিফুল ইসলাম: হ্যাঁ। আমার ভেতর দ্বন্দ্ব কাজ করছিল যে, আমি যাব কি যাব না? আপনাকে আমি নক দেব কি দেব না? তারপর আমি দুপুর তিনটায় আপনাকে টাইম দিলাম কিন্তু আমি চলে এসেছি আড়াইটায়। এখানেও তো একটা দ্বন্দ্ব হয়ে গেছে। এই যে আমি আপনাদের সাথে কথা বলছি। আমি কোন শব্দটা বলব আর কোন শব্দটা বলব না, এটা নিয়েও আমার ভেতরে শাব্দিক দ্বন্দ্ব চলছে।
যমুনা ওয়েব: এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জায়গাটা কী?
শরিফুল ইসলাম: দ্বন্দ্ব থেকে উত্তরণের প্রয়োজন নাই। দ্বন্দ্বে আপনি ভালবাসবেন।
যমুনা ওয়েব: হেগেলের দ্বান্দ্বিক ভাববাদ ও ফয়েরবাখের বস্তুবাদ থেকে সংশ্লেষণের মাধ্যমে এসেছে কার্ল মার্কসের ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’। দ্বন্দ্বের ফলে একটা নির্দিষ্ট জনরা বা বক্সে চলে যাওয়া বা না যাওয়া কতোটুকু অবধারিত? আমি হয়তো ভাববাদের রাস্তায় চলে যাচ্ছি অথবা বস্তুবাদের রাস্তায়। দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে কোনো একটা রাস্তায় চলে যাওয়া কি অপরিহার্য নাকি নির্দিষ্ট কোনো ব্যানারে না থেকেও বিভিন্ন বক্সের এক্সপেরিয়েন্স করা যায়?
শরিফুল ইসলাম: চমৎকার প্রশ্ন। এইটাই আমার চর্চার মূল উদ্দেশ্য। মানে আমার নিজের লাইফের মূল উদ্দেশ্য হলো যে এক্সিস্টেন্সে অনেক কিছু এক্সিস্ট করে। যেহেতু আমরা মানুষ, সাবজেক্টিভ অনেক রিয়ালিটি নিয়ে বাস করি। অনেকগুলো জনরায় আমরা মানুষকে আসলে ভাগ করে ফেলছি। নানান জনরায় জিনিসপত্র ভাগ হয়ে গেছে। এখন মানুষ কী করে? তারা চায়, কোনো এক আইডোলজিতে ঢুকে পড়ে তারপর ওইটাকে ডিপেন্ড করে সারা জীবন চলবে। এতে একটা সুবিধা কি! একটা মজা পাওয়া যায়, একটা মিনিং পাওয়া যায়। তখন এইটার জন্য সে তর্ক করে, একটিভিজম করে। এইটাকে সে বিলিভ করে। তখন সে এইটার জন্য জীবনও দিতে পারে। এইটাকে একটা ‘হোলি জিনিস’ তৈরি করে তারপর সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চায়। সে মনে করে, এটা যদি করা হয় তাহলে সে এক ধরনের কনট্রিবিউশন রাখলো। একটা পজিশনে সে থাকে। এতে হয় কি, রিয়ালিটিতে সে একটা কোনায় পড়ে যায়। একজন মানুষের পক্ষে (আপনার প্রশ্নটা যদি ধরি) তার ব্রেইন বা কনসাসনেসে যতটুকু ক্যাপাসিটি আছে, সে চাইলে সবকিছুকে অবজার্ভ করে করে চলতে পারবে। এবং যদি এভাবে সে চলে, তাহলে অনেক বেশি দ্বন্দ্ব নিয়ে তারপর তার নিজস্ব এক্সপেরিয়েন্স ও এক্সিস্টেন্সকে সে সরিয়ে দিতে পারবে।
যমুনা ওয়েব: এই মিলিত রূপ একীভূত করতে কি শঙ্কা কাজ করে মানুষের? তারা মনে করে, হয় ডানে বা বায়ে যেতে হবে..
শরিফুল ইসলাম: মানুষ এটাকে ভয় পায়। কারণ সে মনে করে, আপনি যদি কোনো বক্সে ঢুকে না যান, তাহলে আপনার দ্বারা বিশৃঙ্খলা হতে পারে পৃথিবীতে। কেওয়াজ করবে, খুবই বিশৃঙ্খলা হবে। এইজন্য মানুষ এটা ভয় পায়। কিন্তু মানুষ এটা জানে না, কেউ যখন সকল বক্স থেকে নিজেকে বের করে ফেলে, তখন আসলে সে মোর এক্সিস্টেন্সের কাছাকাছি চলে যায়। তখন কেওয়াজ দূরে থাক, সে এক্সিস্টেন্সের সাথে হারমোনিয়াস হয়ে যায়। তখন সে কনফ্লিক্টকে, দ্বন্দ্বকে ভালোবেসে রিসিভ করে। তখন সে চিন্তা করতে পারে।
তখন সে একটা এক্সিস্টেনশিয়াল ফর্মে থাকে। আরেকটা হলো ফিজিকাল ফর্ম। তখন সে তার সোসাইটি, তার পরিবার কাউকে ঘৃণা করে না। তাদের সাথে যে হারমোনি রাখা দরকার, ওইটা রেখে চলে কিন্তু চিন্তায় সে পুরো বিশ্বের হয়ে যায়। সকল বক্সকে সে তার অবজারভেশনে রাখে। কোনো বক্সে সে তখন ঢোকে না। না ন্যাশনালিজম, না রেলিজিয়ন, না পলিটিক্স। যে ব্যক্তি সকল বক্স থেকে বের হয়, তার সাথে পুরো এক্সিস্টেন্স তখন এসে হাজির হয়।
যমুনা ওয়েব: আমরা নোটিস করলে দেখতে পাই, অভিজ্ঞতার দ্বারা মানুষের চিন্তায় বদল আসে। এটাও জানি যে, মানুষের চিন্তাধারা ক্রমশ পরিবর্তনশীল। তাহলে যখন কেউ এক বক্স থেকে বিপরীত কোনো বক্সে চলে যায়, তখন তার সমালোচনা করি কেন?
শরিফুল ইসলাম: বেশিরভাগ মানুষই এটা (চিন্তার বদল) জানে না। সে এইটাকে স্বীকারও করতে চায় না। এজন্য খেয়াল করবেন, অনেকদিন পর যদি কোনো স্কুলফ্রেন্ডের সাথে আমাদের দেখা হয়, আমরা বলি যে– ‘দোস্ত, আমার তো কোনো চেঞ্জ হয় নাই, আমি আগের মতোই আছি।’ চেঞ্জ না হলে সেটা নিয়ে সে গর্ববোধ করে। কারণ, মানুষ আসলে পরিবর্তনকে নেগেটিভ হিসেবে দ্যাখে। মানুষ মনে করে, অপরিবর্তিত থাকা হলো শৃঙ্খলার একটা চিহ্ন বা উৎস। কিন্তু আসলে তা না। আসলে আপনাকে চেঞ্জ হইতেই হবে। আপনি এক বক্স থেকে আরেক বক্সে যাবেন। যেতে যেতে একদিন আশা করা যায়, আপনি সকল বক্স থেকে বেরিয়ে যাবেন।

যমুনা ওয়েব: এবার বই নিয়ে প্রশ্ন। আপনার প্রথম বই ‘নির্বাচিত ভিনদেশী গল্প’।
শরিফুল ইসলাম: ওইটা আমার অনুবাদের গল্প। লেখকদের শুরুতে একটা ‘শাই স্টেজ’ থাকে। মানে লাজুক জায়গাটা আর কি। এ কারণে আমারও প্রথম দিকে লেখালেখি করার সাহস হচ্ছিল না। তখন আমি যেটা করলাম, অনুবাদ করা শুরু করলাম। তখন অলরেডি যারা প্রতিষ্ঠিত (তখনকার মেন্টাল স্টেট এমন ছিল), সেখান থেকে আমি অনুবাদ করি। আমি ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছি। সেই কারণে যেসব গল্প আমার ভালো লাগতো, সেই গল্পগুলোই অনুবাদ করে আমার একটা বই হয়। সেইটা আমার প্রথম বই। পরেরটা হলো আমার কবিতার বই। আমি কবিতাও লিখি। কবিতা কীভাবে লিখি, এটা একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। কবিতার যে একটা জেনারেল স্ট্রাকচার। কবিদের বা কবিতার যে স্ট্রাকচার আছে, ওইটাকে চিন্তা করে আমি কবিতা লিখি নাই। আমি যেহেতু এক্সিস্টেন্স নিয়ে চিন্তা করতাম, একটা পর্যায়ে দেখলাম যে এক্সিস্টেন্স এতো মিস্টিরিয়াস, এটা কবিতার মতো। আমি এই ফিলিংটা যদি লিখি, তাহলে দেখি যে– কবিতা দাঁড়ায়।
যমুনা ওয়েব: কবিতার তো কোনো সংজ্ঞা নাই। সো একটা স্ট্রাকচারের মধ্যে থাকা-না থাকা হতেই পারে। অনেকেই নিয়মে থাকে, অনেকেই নিয়ম ভাঙ্গে।
শরিফুল ইসলাম: হ্যাঁ। তখন এরকম কবিতা লিখলাম। আমার কবিতা কেমন হয়েছে, না হয়েছে, সেটা পরের ব্যাপার। তো তারপর আমি কবিতায় থাকি দুই তিন বছর। সেইগুলা একসাথে করে আমার কবিতার বই হয়, নাম ‘শূন্য’। সেইটা প্রকাশ হয় চৈতন্য প্রকাশন থেকে (সিলেটে ২০২০ সালে)।
এরপর এক্সিস্টেন্সিয়াল কুয়েস্ট আর ফিলোসফিক্যাল অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি একটা জিনিস অদ্ভুতভাবে আবিষ্কার করি। আপনার একটা গল্পে এই জিনিসটা আমি পেয়েছিলাম। আপনি যে গল্পটা লিখলেন (গল্পটা পীরেন অথবা প্যারিসের), পড়েছিলাম। ভালো লেগেছিল। যেহেতু আমি মানুষের ফর্মে আছি; সেহেতু অন্য ফিলোসফারের মতো আমিও এই কাজটা করি। এক্সিস্টেন্সকে মানুষ কীভাবে এক্সপেরিয়েন্স করে, এই জায়গা থেকে এক্সপ্লেইন করে। এইটাকে বলে অ্যান্থ্রোপোসেন্ট্রিক চিন্তা। এইটা থেকে আমরা বের হতে পারি না। আমিও খুব একটা বের হতে পারি নাই। আমি চিন্তা করেছি যে, মানুষ কীভাবে সমাজকে দেখে, জীবনকে দেখে, মানুষের মন কীভাবে কাজ করে? এইভাবেই আমি লেখালেখি শুরু করলাম মানুষ নিয়ে। আমি যেহেতু মানুষের চিন্তা নিয়ে এক্সপ্লেইন করার চেষ্টা করেছি, সেই জায়গা থেকে আমি এটার নাম দিলাম ‘নিউরোদর্শন’। নিউরো মানে ব্রেইন, দর্শন হলো ফিলোসফি। তো সেইগুলো আমি একটানা লিখলাম দুই-তিন বছর। লেখার পর সেগুলো কম্পাইল করে ২০২৩-এ কলকাতার তবুও প্রয়াস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় বইটা। ২০২৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের আদর্শ প্রকাশনী থেকে নিউরোদর্শনের পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

যমুনা ওয়েব: আর চলতি বছর কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে আপনার ‘সিনেদর্শন’। ২০২৬-এর অমর একুশে বইমেলায় এটা কি পাওয়া যাবে?
শরিফুল ইসলাম: বইমেলাতেই আমার টার্গেট। যদি প্রকাশকরা রাজি হয় আর কি। রিয়ালিটিতে যখন যেটা মনে হয়, তখন সেটাই ঘটবে। আর যদি এক্সিস্টেন্সের বাইরে কোনো নন-এক্সিস্টেন্স থাকে, সেখানেও হয়তো আমি যাব। হয়তো আমি মারা গেলেই নন-এক্সিস্টেন্সের দেখা পাব।
যমুনা ওয়েব: এই দ্বন্দ্বমুখরতার যাত্রায় আপনার জীবনটা আরও বর্ণিল হোক, সেই শুভকামনা রইলো। যমুনা ওয়েবকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
শরিফুল ইসলাম: আমাকে ডাকার জন্য যমুনা ওয়েবকেও ধন্যবাদ জানাই।
Leave a reply