মৃণাল স্মরণে, মৃণাল সন্ধানে

|

আল মাহফুজ

মৃণাল সেন তখন জীবিত। অনেক বছর সিনেমা বানান না। প্রায় বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছিলেন। সিনেমার ছাত্র ছাড়া তার ছবি নিয়ে কেউ তেমন উচ্চবাচ্য করে না। মৃণাল ‘মুভি’ বানাতেন নাকি ‘সিনেমা’, সেই বিতর্কও চায়ের কাপে ঝড় তোলে না।

অথচ তার প্রয়াণের পর চারিদিকে ‘মৃণাল মৃণাল’ রব উঠলো। সত্যজিত রায়, ঋত্বিক ঘটকের সাথে তার নামেও আঁকা হলো চালচিত্র। তবে তখনও থেমে ছিল না বিদ্রুপের আস্তরণ। ফিল্মরসিক মহলে আবিষ্কার করা গেলো, প্রভাবশালী এই নির্মাতার একখানা সিনেমাও কেউ দেখেনি! ফাঁকা আওয়াজের কামান দাগানো এখনও চলমান। এখনও অনেকেই রুটিন মাফিক ‘মৃণাল’ জপ করে কিন্তু সিনেমাটা ঠিক দেখা হয়ে ওঠে না!

বিংশ‌ শতাব্দীর ত্রিশের দশক স্মরণীয় হয়ে আছে সিনেমাপ্রেমিদের কাছে। এই দশকের প্রথম দিকে বাংলা চলচ্চিত্রের তিন মহারথীর পৃথিবীতে আগমন। ১৯২১ সালে জন্মেছিলেন সত্যজিৎ রায়, ১৯২৩ সালে মৃণাল সেন আর দুই বছর বিরতি দিয়ে ঋত্বিক ঘটক। এরপর তারা নিজস্ব শৈলিতে সিনেমার ভাষা বদলে দিতে থাকলেন, বিশ্ব চলচ্চিত্রকে নিয়ে গেলেন অন্য উচ্চতায়।

আজ বলছি মৃণাল সংবাদ। কালজয়ী এই নির্মাতা জন্মেছিলেন বাংলাদেশের ফরিদপুরে, ১৯২৩ সালের ১৪ মে।‌ ১৭ বছর বয়সে চলে যান কলকাতায়। সেখানেই রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম থেকে একাকার হওয়া। কখনও কখনও সেই সম্পর্ক এগিয়েছে সমানুপাতিক হারে, কখনও ব্যস্তানুপাতিক! এমন করেই একদিন সিনেমার জগতে তার পদার্পণ। প্রথমে নেপথ্যের শব্দকর্মী হিসেবে কাজ করতেন, পরে হয়ে গেলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা।

মৃণাল সেনের সিনেমা পুরোপুরি রাজনীতি কেন্দ্রিক। মৃণালের ছবি দর্শকমনে করাঘাত করে কিন্তু সেই আঘাত প্রায়শই অনিবার্য হয়ে ওঠে। মৃণাল দেখিয়েছেন, কত রকম করে সিনেমার ফর্ম ভাঙ্গা যায়। রিয়েলিটি ফুটিয়ে তোলার জন্য সিনেম্যাটিক কারিকুরির অন্ত রাখেননি। বারবার নিয়ম ভেঙেছেন, এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন। পথ বানিয়েছেন নতুন ন্যারেটিভের। এই তেজোদীপ্ত নির্মাতার ছবিতে ডাইমেনশনের প্রাবল্য ছিল প্রবালের মতো।

চলচ্চিত্র নির্মাতা মৃণাল সেন

নিজের কাজ সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা রাখতেন মৃণাল। ‘কলকাতা ট্রিলজি’ (ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১ ও পদাতিক) ছাড়াও মৃণাল সেনের আরও বেশ কয়েকটি নন্দিত সিনেমা আছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ভুবন সোম’, ‘মৃগয়া’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘চালচিত্র’, ‘খারিজ’ প্রভৃতি। তার বানানো ‘আকালের সন্ধানে’ চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দাগ কেটে যাওয়ার মতো শিল্পকর্ম। জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা আপনি এখানেও অঙ্কিত হতে দেখবেন। ২০০২ সালে মুক্তি পায় তার শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’।

মৃণাল পুরোটাই শ্রেণী সচেতন শিল্পী। আপনি তার ছবি দেখে হয়তো আরাম পাবেন না, হয়তো তার ছবি বানানোর ধরন আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। তারপরও মৃণাল অনস্বীকার্য। তারপরও মৃণালের নাম সত্যজিৎ, ঋত্বিকের সাথে একনিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়।

উপমহাদেশে চিন্তাশীল চলচ্চিত্রের অন্যতম পথিকৃৎ এই নির্মাতার আজ জন্মতিথি। মৃত্যুকালে ‘সজীব’ শিল্পীর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। শ্রাবণে ভরা নদীর বয়স কত? দূর বন থেকে ভেসে আসা সারস কণ্ঠের? কোলাজে কোলাজে দৃশ্যের ভাসান, বয়স কত তার?


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply