অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ উপেক্ষা করে কেবল রাজনৈতিক মতাদর্শ, ব্যক্তিগত অনুভূতি বা হঠাৎ সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করলে ফলাফল হয় ভয়ানক। ইতিহাস তার প্রমাণ দিয়েছে বহুবার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্যারিফ বা শুল্কনীতি নিয়েও অর্থনীতিবিদরা এমনই ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি যুক্তরাষ্ট্রে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি মন্দার সম্ভাবনাও তৈরি করেছে। কারণ, আমেরিকার শুল্ক আরোপের জবাবে অন্যান্য দেশও পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে, যার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, এই পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রকে ষাটের দশকের পর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে—যেখানে মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দা একসাথে আসে, যাকে বলা হয় স্ট্যাগফ্লেশন—নিয়ে যেতে পারে।
ইতিহাসের পাতায় বারবার ফিরে আসে একই ভুল:
এই ধরনের ভুল শুধু ট্রাম্প করেননি। ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে, নেতারা অর্থনীতিবিদদের উপদেশ না শুনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন।
১৭৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান রচনার পর অ্যালেক্সান্ডার হ্যামিলটনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যাংক অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস, যা আজকের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো কাজ করতো। এটি দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক ছিল। তবে ১৮১১ সালে ব্যাংকটির সনদ নবায়নে কংগ্রেস বিভক্ত হয়ে পড়ে, ফলে এটি বন্ধ হয়ে যায়। এর পরবর্তী পাঁচ বছরে এক বড় ধরনের আর্থিক মন্দা দেখা দেয়।
এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ১৮১৬ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ব্যাংকটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়, যেটি ইতিহাসে পরিচিত সেকেন্ড ব্যাংক অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস নামে। নিকোলাস বিডল এর পরিচালক হন, যিনি ছিলেন শিক্ষিত ও প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি। তার দক্ষ পরিচালনায় ব্যাংকটি অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনে এবং মুদ্রানীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
কিন্তু ১৮৩২ সালে ব্যাংকটির সনদ নবায়নের সময়, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ব্যক্তিগত বিরাগ ও রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে এটি ভেটো করেন। যদিও তিনি জানতেন, ব্যাংকটি অর্থনীতির জন্য ভালো তবুও তিনি শিক্ষিত ও প্রভাবশালী শ্রেণিকে সন্দেহ করতেন। তার এই সিদ্ধান্ত ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয় এবং দেশে অপ্রতুল অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কারণে একের পর এক আর্থিক সংকট শুরু হয়।
ব্রিটেনেও ঘটেছে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি:
এই ধরনের নীতিগত ব্যর্থতা কেবল আমেরিকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। ব্রিটেনেও এমন উদাহরণ আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে অনেক দেশ সোনামূল্য মান বা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করতো, যার ফলে তারা তাদের মুদ্রার মান সোনার সঙ্গে নির্ধারণ করতো। এতে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হলেও অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় সরকারের ক্ষমতা সীমিত হয়ে যেতো।
যুদ্ধের পর বেশিরভাগ দেশ গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড থেকে সরে এলেও, ১৯২৫ সালে ব্রিটেন আবার পুরোনো হারে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল অর্থনীতিবিদদের স্পষ্ট বিরোধিতা সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত নেন। তার পরামর্শদাতা অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস ব্যক্তিগতভাবে চার্চিলকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, এই সিদ্ধান্ত ব্রিটিশ রফতানি খাত ও শ্রমিকদের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।
তবুও চার্চিল ঐতিহ্য, ব্রিটিশ গর্ব ও নস্টালজিয়ার কারণে অর্থনৈতিক বাস্তবতা অগ্রাহ্য করেন। ফলাফল ছিল বিপর্যয়কর। দশকের শেষে যখন ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনীতি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে, ব্রিটেনের অর্থনীতি তখন কেবল ২০ শতাংশ বেড়েছিল। ১৯২৬ সালে শ্রমিকরা বেতন কাটার প্রতিবাদে সাধারণ ধর্মঘটে যায়। কয়লা শ্রমিকদের আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয়। অবশেষে ১৯৩১ সালে একটি আর্থিক সংকটে ব্রিটেন গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির শঙ্কা:
আজ যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্ক আরোপের মাধ্যমে অর্থনীতি চালাতে চান, তখন অনেকেই বলছেন– তিনি হয়তো অ্যান্ড্রু জ্যাকসন বা উইনস্টন চার্চিলের মতোই ইতিহাসের এক ভুল পদক্ষেপ নিতে চলেছেন। অর্থনীতিবিদদের সতর্কতা সত্ত্বেও যদি তিনি এই নীতি চালিয়ে যান, তবে তা শুধু মার্কিন অর্থনীতিকেই নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতিকেও গভীর সংকটে ফেলতে পারে।
অর্থনীতিতে একটি সাধারণ নিয়ম হলো— সাবধানতা ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া। যখন নেতারা কেবল রাজনীতি বা ব্যক্তিগত মতাদর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন এবং অর্থনীতিবিদদের বাস্তবভিত্তিক পরামর্শ অগ্রাহ্য করেন, তখনই ঘটে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুলগুলো।
ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতি আদতে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ভয়াবহ স্থানে নিয়ে যেতে পারে; যেখানে ব্যয় বাড়বে, বেকারত্ব বাড়বে এবং জনগণের ভোগান্তি চরমে পৌঁছাবে। এর থেকে শিক্ষা নেয়ার সময় এখনই।
(টাইম ম্যাগাজিন থেকে অনূদিত )
Leave a reply