ওয়াহ ব্রাদার্স: ক্রিকেটের ক্যানভাসে নিপুণ নেতা-শিল্পী

|

মেহেদী হাসান রোমান ⚫

দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায় জুন মাস আদতে শীতের আগমনী বার্তা দেয়। যে সময়ের কথা বলছি, তখন ক্রিকেট মানে লাল বলের ম্যাচ। ওয়ানডে কিংবা হালের টি-টোয়েন্টির জন্মই হয়নি। বছর দুয়েক হলো লিস্ট-এ ম্যাচের সাথে পরিচিত হয়েছে ক্রিকেট। ১৯৬৫ সালের ২ জুন। সিডনীর উপকণ্ঠে ক্যান্টারবুরিতে জন্ম ‘ওয়াহ ব্রাদার্সের’। রাইট ভাতৃদ্বয়কে পৃথিবী মনে রেখেছে উড়োজাহাজ আবিস্কারের জন্য। আর ওয়াহ ব্রাদার্স?

পৃথিবীতে তুলনা জিনিসটা আপেক্ষিক। এর নির্দিষ্ট কোনো স্কেল নেই যার মানদণ্ডে পরিমাপ করা যায়। একেকজন একেক দৃষ্টিতে দেখে। টম ক্রুজকে তার অভিনীত কোনো ফিল্মের রিমেকে কাজ করতে বললে তিনি-ও একই দৃশ্যের সংলাপ কিংবা অঙ্গভঙ্গি আগের ফিল্মের ন্যায় হুবুহুভাবে দিতে ব্যর্থ হবেন। তাই মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে জন্ম নেয়া একই জিন/ডিএনএধারী জমজ সহোদর স্টিভ ও মার্ক ওয়াহ’র সামর্থ্যের ভিন্নতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যমজ হলেও দুজনের স্বভাবগত পার্থক্য রয়েছে।

নেতৃত্বগুণের পসরা সাজিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে তর্কসাপেক্ষে সফলতম অধিনায়ক বনে যাওয়া স্টিভ যদি ভালো পরিচালনাকারী হন, মার্ক তাহলে একজন ‘অধিকতর ভালো’ শিল্পী যারা দুজনেই ‘অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ পেতে পারেন। স্টিভের নেতৃত্ব আর মার্কের নান্দনিক ব্যাটিং— ক্রিকেটে তাদের অনন্যতা প্রকাশ করেছে।

ঘরোয়া ক্রিকেটে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে একসঙ্গে খেলেছেন স্টিভ-মার্ক।

ব্যাট হাতে ১৬৮ টেস্টে স্টিভ ওয়াহর গড় ৫১। ৩২টি সেঞ্চুরিসহ তার রান প্রায় ১১ হাজার। একদিনের ম্যাচেও রয়েছে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার রানের সঙ্গে ও ৩টি শতক। বোলার হিসেবেও স্টিভ মন্দ না। টেস্ট ও ওয়ানডেতে তার উইকেট সংখ্যা যথাক্রমে ৯২ ও ১৯৫। আসলে ‘বিখ্যাত অধিনায়ক’- এই বিশেষণটি স্টিভের গায়ে এমনভাবে লেগে আছে, যেখানে তার ব্যাটার স্বত্ত্বাকেই তুলনামূলক কম আলোচিত বলা যায়। সেখানে দুই ফরম্যাটে ২৮৭টি উইকেটও যেনো অনুমিতভাবেই আড়ালে।

অপরদিকে, ১২৮ টেস্টে ২০ সেঞ্চুরিসহ ৪১ গড়ে ৮ হাজারের উপর রান মার্ক ওয়াহর। ওডিআইতে প্রায় ৪০ গড়ে ঠিক সাড়ে ৮ হাজার রানের সঙ্গে ১৮ বার পেরিয়েছেন তিন অঙ্কের রান। ওয়ানডে ফরম্যাটে স্টিভের চেয়ে ব্যাটার হিসেবে সফল মার্ক।

সংখ্যার বিচারে হিসাব করলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ক্যারিয়ার স্টিভ ওয়াহর কিছুটা লম্বা। মার্কের চেয়ে তিন বছর আগে (১৯৮৫) অভিষেক হওয়া স্টিভ দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব ছেড়েছেন মার্কের অবসরের আরও বছর দুয়েক পর (২০০৪)।

এদিকে, ফিল্ডার হিসেবে মার্কের অনন্য এক কীর্তি রয়েছে। ২০০৯ সালে রাহুল দ্রাবিড় সেই কীর্তি টপকানোর আগ পর্যন্ত মার্ক নন-উইকেটকিপার হিসেবে টেস্টে সর্বোচ্চ (১৮১) ক্যাচ নেয়া ক্রিকেটার ছিলেন। মার্ক ভালো পার্টনারশিপ ভাঙা বোলার হিসেবেও ছিলেন পটু।

‘মার্ক ওয়াহ: দ্য বায়োগ্রাফি’ বইয়ের ভূমিকায় অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক অ্যালোন বোর্ডার বলেছেন, মার্ক খুবই শান্ত ও সহজ-সরল। এই ছেলেটি অস্বাভাবিক কিছু, যে ধরণের খেলোয়াড়রা খুব বেশি আসে না।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে স্টিভ-মার্ক।

‘সর্বকালের সেরা’- এই শব্দ নিয়ে বিতর্ক থাকে। ডন ব্র্যাডম্যানকে বলা হয়ে থাকে সর্বকালের সেরা ব্যাটার। কিন্তু বিতর্ক করতে চাইলে শচীন, লারা কিংবা হালের ভিরাট কোহলিকে আপনি একেবারে আগ্রাহ্য করতে বা ফেলে দিতে পারবেন?

তবে, ‘স্টিভ ওয়াহ সেরা টেস্ট অধিনায়ক’— এই শিরোনামে বিতর্ক হলে সেই বিতর্কে বিপক্ষ দল কতগুলো পয়েন্ট দাঁড় করিয়ে কতক্ষণ কথা বলতে পারবে, এটিও প্রশ্ন। কারণ, স্টিভকে সেরা টেস্ট অধিনায়ক বলার পক্ষের কারণ, পরিসংখ্যান এবং যুক্তি অহরহ।

বিশেষণ-বিশ্লেষণ তো হলো, এবার একটা ভিন্ন গল্প বলা যাক। দুই ভাইকে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে একসাথে দেখা গিয়েছিলো ১৯৮৮ সালে, সেটি ছিলো ওয়ানডে ম্যাচ। তবে টেস্টে ড্রেসিংরুম শেয়ার করার নেপথ্য রয়েছে অন্যরকম এক ঘটনা।

নিজের অভিষেক ম্যাচে মার্ক খেলেন ১৩৮ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পোর্ট অব স্পেন টেস্ট দিয়ে কয়েক ম্যাচ পর দলে ফেরেন স্টিভ ওয়াহ। সেবারই ‘ওয়াহ ব্রাদার্স’কে একসাথে টেস্ট ম্যাচে খেলতে দেখে বিশ্ব। প্রায় এক যুগ স্টিভ ও মার্ক ছিলেন অস্ট্রেলিয়া টেস্ট দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১০৮ টেস্টের পাশাপাশি ২১৪ ওয়ানডের অজি একাদশে ছিলেন একসঙ্গে।

লর্ডসের ব্যালকনিতে বিশ্বজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে স্টিভ-মার্ক। তাদের সঙ্গে শেন ওয়ার্ন।

মার্ক ওয়াহর টেস্ট অভিষেক হয়েছিল স্টিভ ওয়াহর দল থেকে বাদ পড়ার কারণে। ১৯৯০ সাল স্টিভের জন্য অদ্ভুত এক বছর ছিলো। সেবার কোনো ফরম্যাটেই শতক বা অর্ধশতকের দেখা পাননি তিনি। সেই মৌসুমে অ্যাশেজের তৃতীয় ম্যাচ, সিডনি টেস্টে ১৪ রানে আউট হওয়ার পরেই স্টিভের বাদ পড়া অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়। তবে স্টিভের পরিবর্তে দলে যখন মার্কের অভিষেক হতে চলেছে তখন তাদের মা (বেভারলি ওয়াহ) কেমন বোধ করেছিলেন, তা আমাদের জানা নেই। ভদ্রমহিলা যদি কোনো অটোবায়োগ্রাফি লিখতেন তাহলে আমরা হয়ত জানতে পারতাম। তবে, সেই সম্ভাবনাও এখন আর নেই।

১৯৯৬ বিশ্বকাপে রানার্সআপ কিংবা ১৯৯৯ সালে একযুগ পর অজিদের বিশ্বকাপ পুনরুদ্ধারে ছিলেন দুই ভাই। লাহোরে না পারলেও লর্ডসে শিরোপা উঁচিয়েছিলেন একসঙ্গে। আপন দুই ভাইকে তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হরহামেশাই খেলতে দেখা গেছে, কিছু ওয়ানডে বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন সহোদর কি আছে? হ্যা আছে। স্টিভ আর মার্ক।

/এমএইচআর


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply