মেহেদী হাসান রোমান⚫
বছরখানেক আগেও ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ হতো অনেকটাই ছোট পরিসরে। অনেকে বলতেন বার্ষিক একটা নিয়ম রক্ষার টুর্নামেন্ট আয়োজন করে ফিফা। আবার এই আসর আয়োজনে ফিফা নাকি আয়োজক দেশ চূড়ান্ত করেই নিজেদের কাজ অনেকটা শেষ করে ফেলতো, আয়োজক দেশের ফুটবল বোর্ডই বেশিরভাগ দায়িত্ব পালন করতো— শোনা গেছে এমন অনেক কথা। প্রতিটা মহাদেশের চ্যাম্পিয়ন ক্লাবের সঙ্গে আয়োজক দেশের লিগজয়ী দল নিয়ে মাঠে গড়াতো এই টুর্নামেন্ট। এবার সেই রেশে পরিবর্তন এসেছে। বিশাল পরিসরে অনুষ্ঠিত হবে এবারের আসর। রয়েছে প্রাইজমানি তথা অর্থের ঝনঝনানি-ও। তবে এই বড় পরিবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে ফিফার আরেকটি টুর্নামেন্টের বিদায় ঘণ্টা বাজার গল্প।
ফিফা ‘কনফেডারেশন কাপ’ নামে একটি টুর্নামেন্ট আয়োজন করতো। ১৯৯২ সালে শুরু হওয়া সেই টুর্নামেন্টের আদি নাম ‘কিং ফাহাদ কাপ’। মূলত সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশাহর নামে চালু হয় এটি। উদ্দেশ্য ছিল দেশটির ফুটবলে নবজাগরণ সৃষ্টি করা। সৌদি জাতীয় দলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি মহাদেশের চ্যাম্পিয়ন দেশও অংশ নেয় ১৯৯২ ও ১৯৯৫ সালের আসরে।
১৯৯৭ সালে ফিফা এটির সঙ্গে যুক্ত হয় এবং নতুন নাম দেয়। ২০০৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবার দু’বছরের ব্যবধানে মাঠে গড়ায় এটি। তবে, ২০০৫ সালের আসর থেকে ফিফা আয়োজক দেশ নির্ধারণে নতুন এক নিয়ম চালু করে। পরবর্তী বিশ্বকাপের আয়োজক দেশেই অনুষ্ঠিত হবে কনফেডারেশন কাপ। এতে পরের বছর বিশ্বকাপ আয়োজনের একটা প্রস্তুতিও হয়ে যাবে। ২০০৫ থেকে সর্বশেষ ২০১৭ সাল পর্যন্ত এভাবেই আয়োজিত হয় এটি।

বিপত্তি বাধে ২০১৫ সালে। ২০১০ সালেই চূড়ান্ত হয় ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হবে কাতার। আগের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালের কনফেডারেশন কাপ কাতারে নয়, বরং এশিয়ার অন্য কোনো দেশে আয়োজনের রূপরেখা দেয় তারা। এর পরিবর্তে, প্রথমবারের মতো পরের বছর বিশ্বকাপের পরীক্ষামূলক আসর হিসেবে বড় পরিসরে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের ধারণা ও প্রস্তাব তোলে যা ২০২১ সালে কাতারেই অনুষ্ঠিত হবে— এমনটাই বলা হয়।
২০১৯ সালে ফিফা ‘কনফেডারেশন কাপ’ বিলুপ্ত ঘোষণা করে। রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত আসরটিই সর্বশেষ আসর হিসেবে বিবেচিত হয়।
এখন এই টুর্নামেন্টের সফল রিপ্লেসমেন্ট কী হতে পারে? যেখানে কনফেডারেশন কাপ বিলুপ্ত, ক্লাব বিশ্বকাপও নামেমাত্র কয়েকটি দল নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এই দুই টুর্নামেন্টের মেলবন্ধন কীভাবে বড় পরিসরে করা যায়, সেটি নিয়েই হতে থাকে আলোচনা।

সমাধান আসে জাতিগত মেলবন্ধনের বিশাল ফ্লেভার থাকবে, মানে অনেক দেশের অনেক খেলোয়াড় সেই নতুন টুর্নামেন্টে খেলবে, এর পাশাপাশি সেটি জাতীয় দলের টুর্নামেন্ট হবে না, ফরম্যাট হবে ক্লাবভিত্তিক। তবে প্রচলিত ক্লাব বিশ্বকাপের আঙ্গিকে নয়, এটিকে নতুন রূপ দিতে হবে।
আগের ক্লাব বিশ্বকাপে মহাদেশীয় চ্যাম্পিয়নরা (উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, কোপা লিবের্তাদোরেস, এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগ, সিএএফ চ্যাম্পিয়নস লিগ, কনকাকাফ চ্যাম্পিয়নস কাপ এবং ওএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী) খেলতো। এবার ক্লাবের সংখ্যা বাড়ানো হবে। ৬-৭টি ক্লাব নয়, ক্লাব থাকবে ৩২টি। অবশ্য শুরুর দিকের প্রস্তাবে দলের সংখ্যা ধরা হয়েছিল ২৪টি, পরে তা আরও বাড়ানো হয়।
এতে আউটপুট কী? সার্বিক ফলাফল হলো, আগে উয়েফার চ্যাম্পিয়ন দলই খেলতো। এক রিয়াল মাদ্রিদ সুযোগ পেলে সেখানে কতজন স্টারের খেলা দেখতে পারতো দর্শকরা? প্রথম রাউন্ডেই ওএফসি কনফেডারেশনের একটি দল নিয়মিত বাদ যেত। বলা যায়, উয়েফার প্রতিনিধির সাথে ওএফসি বা ওশেনিয়া অঞ্চলের ক্লাবটির দেখা-ই হত না। এখন যেহেতু স্লট বেড়ে গেছে, তাই বায়ার্ন মিউনিখের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড সিটি এফসি কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার সানডাউনস ক্লাবের ম্যাচ হতেই পারে। অনেকটা জার্মানি বনাম নিউজিল্যান্ড বা জার্মানি বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের আবহ পাবে দর্শক।

এই বড় পরিসরের ক্লাব বিশ্বকাপের পরিধি কতটা বেড়েছে তা অনুমান করা যায়। কনফেডারেশন কাপের লক্ষ্য ছিল কী? বিশ্বকাপের আগের বছর সেই দেশে এই আসরটি আয়োজন করে পরের বছর মেগা ইভেন্টের একটা প্রস্তুতি নেয়া। ২০২৬ বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করবে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা-মেক্সিকো। এবারের ক্লাব বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে মার্কিন মুলুকে।
তাই বলা যায়, ফিফা কনফেডারেশন কাপই শুধু বন্ধ হয়নি, বন্ধ হয়েছে আগের ফরম্যাটের ছোট পরিসরের ক্লাব বিশ্বকাপও। আর ৩২ দলের বিশাল ক্যানভাস ‘বিলুপ্ত হওয়া আগের দুই টুর্নামেন্টের’ সবদিক ঠিক রাখার পাশাপাশি পরিধি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
২০০০ সালে শুরু হওয়া ক্লাব বিশ্বকাপে গত দুই যুগে একচেটিয়া আধিপত্য ছিল ইউরোপিয়ান দলগুলোর। চারবার অবশ্য শিরোপা জিতেছে দক্ষিণ আমেরিকান ক্লাব। অপরদিকে, কনফেডারেশন কাপে ব্রাজিল ছিল দুর্দান্ত। হ্যাটট্রিকসহ চারবার শিরোপা জিতেছিল তারা। এর বাইরে একবার মেক্সিকো, বাকিগুলো ইউরোপের দেশ। সর্বশেষ আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানি। অবশ্য জাতীয় দলের আসর হলেও একটা মিথ প্রচলিত ছিল, ‘কনফেডারেশন কাপ জেতা কেউ পরের বছর বিশ্বকাপ জেতে না’। অবশ্য এটি হতেও দেখেছে ফুটবল ভক্ত-সমর্থকরা।

মূলত, বিলুপ্ত এই দুই আসরকে ব্লেন্ডারে দিয়ে আরও কিছু ফ্লেভার-সিরাপ যুক্ত করে নতুন মোড়কে এসেছে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ। ফিফা বিশ্বকাপে অঘটন আমরা দেখেছি অনেক। ফ্রান্সকে হারিয়ে দিয়েছে সেনেগাল, এরকম অনেক ম্যাচ আছে। বোকা জুনিয়র্সকে অকল্যান্ড সিটি হারাতে পারবে কি না, আমরা জানি না। তবে পিএসজির সাথে যদি রিভার প্লেটের দেখা হয় সেটি ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনার অনুভূতি দিলেও দিতে পারে। ক্লাব ফরম্যাটও থাকলো, ৫০টি দেশের খেলোয়াড়ও আসরজুড়ে খেললো। ক্যানভাসটা কত বড় খেয়াল করেছেন?
আগামী বছরের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি তো বটেই, মনে রাখার মতো একটা টুর্নামেন্ট হতে যাচ্ছে ‘ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ ২০২৫’। এই শিরোপা জিতলে প্রাইজমানি হিসেবে একটি ক্লাব যা পাবে, তা বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা সবশেষ কাতার বিশ্বকাপ জিতেও পায়নি।
/এমএইচআর
Leave a reply