Site icon Jamuna Television

স্টোকসের ডিকশনারিতে ‘ড্র’ বলতে কিছু নেই

আল মাহফুজ

হেডিংলিতে প্রথম টেস্টের শেষ দিনে মাত্র ৭৬ ওভারেই সাড়ে তিনশ’ রান তুলে ভারতকে পাঁচ উইকেটে হারিয়েছে ইংল্যান্ড। অন্যদিকে, এক টেস্টে ৫ সেঞ্চুরির পরও পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়েছে ভারতকে। ১৪৮ বছরের টেস্টের ইতিহাসে এমন চিত্র আর কখনোই দেখা যায়নি!

চতুর্থ ইনিংসে ৩৭১ রানের লক্ষ্য তাড়া করা এই জয়ে ইংল্যান্ড আরেকবার মনে করিয়ে দিলো– এখন যুগ ‘বাজবল’ ক্রিকেটের। বেন স্টোকসরা রান তাড়া করে জয়ের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাচ্ছে যেন নিজেদেরই। টেস্টে বড় রান তাড়ার ব্যাপারটি ইংলিশ ব্যাটাররা এখন এতোটাই নিয়মিত করে তুলছে যে, দেখে খুব স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু ব্যাপারটা বছর তিনেক আগেও এমন স্বাভাবিক ছিল না।

২০২২ সালের ১২ মে ইংল্যান্ডের প্রধান কোচ করা হয় সাবেক কিউই ক্রিকেটার ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে। অধিনায়কত্বের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয় বেন স্টোকসকে। ম্যাককালাম এর আগে ত্রিনবাগো নাইট রাইডার্স ও কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে কোচিং করিয়েছেন। সেখানে তিনি স্বাক্ষর রাখেন তার ক্রিকেটীয় দর্শনের। ম্যাককালামের ক্রিকেটীয় দর্শন হলো অতি আক্রমণাত্মক ক্রিকেট। অধিনায়ক বেন স্টোকসের দর্শনও অনেকটা সেরকম। তারা দুজন মিলে টেস্ট ক্রিকেটে চালু করেন এক নতুন ‘ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট’।

ভয়ডরহীন মানসিকতার এই খেলার ধরনকে নাম দেয়া হয় ম্যাককালামের ডাকনাম ‘বাজ’ থেকে। শুরু হয় ‘বাজবল’ ক্রিকেট। বাজবলের চাক্ষুস সাক্ষীদের কাছে সাদা বলের এই ফরম্যাট এখন উপভোগ্য হয়ে উঠছে। কেননা, পূর্বেকার দিনে টেস্টে ম্যাড়ম্যাড়ে ড্র নিয়মিত দেখা যেতো। এতে দর্শকের জন্য অনেকটাই বিরক্তিকর হয়ে উঠতো খেলাটা। এখন আর ড্র দেখার চান্স নেই! কারণ, স্টোকসের ইংল্যান্ড ড্রর জন্য খেলে না।

দুঃসাহসী রিপোর্টার ও অভিযাত্রী টিনটিনের (কমিকস ক্যারেক্টার) ডিকশনারিতে যেমন ভয় নামক কোনো শব্দ নেই, তেমনি স্টোকসের ডিকশনারিতে ‘ড্র’ বলতে কিছু নেই। হয় জয়, নয় ক্ষয়! স্টোকসির অধীনে তার দলের কেবল একবার ড্র করাই এর প্রমাণ। আর সেই ম্যাচটি ড্র হয়েছিল বৃষ্টির কারণে।

স্টোকসের অধিনায়কত্বে ৩৫ টেস্টে ২২টি জয় এসেছে। বিপরীতে ১২টি ম্যাচে হার দেখেছে ইংলিশরা। তাই হেডিংলি টেস্টের শেষ দিনে যখন ডাকেটদের সামনে সমীকরণ ৩৫০ রান, হাতে ১০ উইকেট— তখন তারা যে নিশ্চিতভাবে জয়ের পেছনে ছুটবে, সেটি বাজবলপ্রমিদের জানা ছিল। ঘটেছেও তাই। কারণ, স্টোকস-ম্যাককালামের ক্রিকেটীয় দর্শনে ড্রর কোনো জায়গা নেই।

হেডিংলিতে ভারতকে হারিয়েছে স্টোকস বাহিনী

বাজবল মানে শুধু বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান তোলা কিংবা ‘ব্রামবেলা’ ফিল্ড সেটআপ করে বিপক্ষকে ভড়কে দেয়া নয়, এটি দর্শকের বিনোদনের খোরাকও যোগায়। বাজবল মানে দলের মানসিকতায় আক্রমণাত্মক ছাপ থাকা। বাজবল মানে প্রতিটা বলে কিছু না কিছু ঘটার সম্ভাবনা তৈরি করা। বাজবল দর্শককে মুগ্ধ করছে, টেস্ট ক্রিকেটটা হয়ে গেছে বানের জলের মতো।

পূর্বে টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে আড়াইশ’ তাড়া করে জেতাটাই ভীষণ চ্যালেঞ্জিং ছিল। অকুতোভয় কিছু ক্রিকেটারের কারণে এখন তা আর অসাধ্য নয়। বেন স্টোকসের অধীনে তার দল ২৫০ রানের বেশি তাড়া করে ছয়বার জিতেছে। সব দল মিলিয়েও এই কীর্তি চারবারের বেশি কেউ করতে পারেনি। তাহলেই বুঝুন, তিন বছরে বাজবলের ইমপ্যাক্ট কতখানি!

ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজবলে অন্য দলের প্রভাবিত হওয়ার ব্যাপারটা দৃশ্যমান। ব্যাটার, বোলার, অধিনায়করা এখন আগের চেয়ে আরও বেশি আক্রমণাত্মক। প্রতি মুহূর্তে কিছু না কিছু করার মানসিকতা এসেছে খেলোয়াড়দের মাঝে।

তাদের মতে, ভবিষ্যতেও টেস্ট ক্রিকেটে রাজত্ব করবে বাজবল। কেন নয়? কারণ, বাজবল টেস্টে রোমাঞ্চকর ফলাফল উপহার দেয়। ক্রিকেটারদের পরিবর্তিত মানসিকতার সাথে খাপ খেয়ে যায়। স্টোকসের এই আগ্রাসী দর্শন দর্শকের চাহিদাও পূরণ করে। বলাই বাহুল্য, দর্শক আয়েশ করে টিভিসেটের সামনে বসে এমন উত্তেজনাপূর্ণ ‘টেস্ট’ খেলাই সবসময় দেখতে চাইবে।

লেখাটা শেষ করছি বেন স্টোকসের বচন টেনে। হেডিংলি ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে ইংলিশ কাপ্তান বলেন, ‘আমাদের মানসিকতা ঠিক রাখার কারণেই জিততে পেরেছি। যতোবার চাপে পড়েছি, ততোবার ভালো খেলেছি। এটা শুধু স্কিলের ব্যাপার নয়, ড্রেসিংরুমের ইতিবাচক মানসিকতাও জয়ের অন্যতম চাবিকাঠি।’

Exit mobile version