আবারও প্রাণ ফিরছে তেহরানে, তবে মানুষ এখনও আতঙ্কে

|

ইরানের রাজধানী তেহরানের হৃদয়ে অবস্থিত বুফ ক্যাফে স্থানীয় লোকজনের কাছে বহু বছর ধরে কফি পরিবেশন করছে। সম্ভবত এখানকার ‘আইসড আমেরিকানো কফি’ সারা শহরের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়—কারণ এই ক্যাফেটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা মার্কিন দূতাবাসের নিকটে অবস্থিত।

১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব ও জিম্মি সংকটের পর ওয়াশিংটন যখন তেহরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে, তখন থেকে এই দূতাবাসের উঁচু সিমেন্টের দেয়াল আমেরিকা-বিরোধী ম্যুরালে ঢেকে দেয়া হয়েছে। আজও সেই ইতিহাস ইরান-মার্কিন জটিল সম্পর্কের উপর দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে।

আশ্চর্য সুন্দর বুফ ক্যাফের ভেতরে কর্মরত আমির বলছেন, তিনি চান আমেরিকা ও ইরানের সম্পর্ক উন্নত হোক।
‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আমাদের ব্যবসায় ক্ষতি করছে এবং বিশ্বজুড়ে ভ্রমণকে কঠিন করে তুলেছে।’

 বুফ ক্যাফেতে কর্মরত আমির। ছবি: বিবিসি নিউজ।

তিনি বলেন, দোকানে একটি কাঠের সাইনবোর্ডে লেখা—’শান্ত থাকুন এবং কফি পান করুন’।

যুদ্ধ শেষ হবার পর ক্যাফেতে মাত্র দুটি টেবিলে লোক বসেছে—একটিতে একজন দীর্ঘ কালো ঘোমটা পরা নারী, অন্যটিতে নীল জিন্স পরা লম্বা চুলওয়ালা এক তরুণী, যে তার বন্ধুর সাথে বসে রয়েছে, ইরানের পোশাক নিয়মকে উপেক্ষা করে।

এটি তেহরানের একটি ক্ষুদ্র চিত্র, যে শহর আজ তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।

কিছু দূরে, ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আইআরআইবি-র কমপ্লেক্সে, স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির একটি রেকর্ডকৃত বক্তব্য সম্প্রচার করা হয়।


তিনি ঘোষণা করেন, আমেরিকানরা শুরু থেকেই ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরোধিতা করে আসছে। মূল বিষয়টি হলো—তারা চায় আমরা আত্মসমর্পণ করি।

দেশটির সর্বোচ্চ এই নেতাকে ইসরায়েলের ব্যাপক বিমান হামলা ও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও বিজ্ঞানীদের হত্যার পর একটি বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।

তালেগানী জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে হেড নার্স আশরাফ বারঘি। ছবি: বিবিসি নিউজ।

শহরের হাসপাতালগুলোতে এখনও ইসরায়েলের ১২ দিনের যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা চলছে। তালেগানী জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে হেড নার্স আশরাফ বারঘি বলেন, ‘আমি ভয় পাচ্ছি তারা আবার হামলা করতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি না এই যুদ্ধ শেষ হয়েছে’।

এর আগে, গত ২৩ জুন এভিন জেলের কাছে ইসরায়েলের হামলায় আহত সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকদের এই ওয়ার্ডে আনা হয়েছিল। 

আশরাফ বারঘি এও বলেন, ‘আমার ৩২ বছরের নার্সিং জীবনে এত ভয়াবহ জখম আমি আর দেখিনি’।

ইসরায়েল এই কুখ্যাত জেলকে ‘প্রতীকী লক্ষ্য’ বলে আক্রমণ করেছিল, যা ইরানের রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য পরিচিত। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বারবার ইরানিদের ‘স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে’ বলেছেন।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মোর্তেজা বলেন, ‘ইসরায়েল বলে তারা শুধু সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করেছে, কিন্তু এগুলো সব মিথ্যা’। 

জেলের ট্রান্সপোর্ট বিভাগে কাজ করার সময় মিসাইলের আঘাতে মোর্তেজার হাত ও পিঠে গুরুতর জখম হয়।

ইরানি কর্তৃপক্ষ লাইস ডুসেটের রিপোর্টিং নিয়ে শর্ত দিয়েছে যে তার কোনো প্রতিবেদন বিবিসি পারসিয়ান সার্ভিসে ব্যবহার করা যাবে না। এটি ইরানে কাজ করা সব আন্তর্জাতিক মিডিয়ার জন্য প্রযোজ্য।

তেহরান ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে, অন্ততপক্ষে বাইরে থেকে। রাস্তায় আবারও যানজট শুরু হয়েছে, সুন্দর গাছ-ঘেরা পথে মানুষ চলাফেরা করছে। বাজারের দোকানগুলো খুলছে, যেসব মানুষ বোমার ভয়ে শহর ছেড়ে গিয়েছিল, তারা ফিরছে।

কিন্তু ইসরায়েলের ১২ দিনের তীব্র সামরিক অভিযান ও মার্কিন হামলা ইরানিদের মনে গভীর আঘাত রেখে গেছে।

আজাদি টাওয়ারের নিচে এক তরুণী মিনা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘এগুলো ভালো দিন ছিল না। আমরা একটি ভালো জীবনের জন্য কত চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখন কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি না’।

একটি উন্মুক্ত কনসার্টে তেহরান সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা দেশপ্রেমের গান বাজাচ্ছিল, মানুষ একসাথে হয়েছিল—কিন্তু সবাই তাদের দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।

‘সরকারকে মানুষের কথা শুনতে হবে,’ বলেন আলি রেজা। ‘আমরা শুধু স্বাধীনতা চাই,’ তিনি যোগ করেন।

নিয়ম-নিষেধের মধ্যে থেকেও ইরানিরা তাদের মনের কথা বলছে, অপেক্ষা করছে তাদের নেতা, ওয়াশিংটন ও বিশ্বনেতাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য—যা তাদের জীবনে বড় প্রভাব ফেলবে।

/এআই


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply