
গত বছর গুটিগুটি পায়ে ক্যালেন্ডারে যখন হাজির হলো ৩ জুন, আমাদের মনে পড়লো– লেখক ফ্রানৎস কাফকার মৃত্যু হয়েছে ১০০ বছর আগে। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার পাশের এক উপশহরে যক্ষ্মায় ভুগে মৃত্যু হয় কাফকার। একসময় তার অবস্থা এতোটাই বেদনাদায়ক হয়ে পড়ে যে, খাবার গলাধঃকরণ হতো না।
গত শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক কাফকা। লেখালেখির রাজমহলে তার আসন এতোটাই উচ্চ অবস্থানে যে, সাহিত্যে নোবেলজয়ী অন্তত ৩২ জন লেখক তাদের লেখায় কাফকার সরাসরি প্রভাবের কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু চিত্রশিল্পী কাফকা? তাকে কয়জন চেনেন?
কাফকার জন্মদিন আজ (৩ জুলাই)। চিত্রশিল্পী কাফকার অজানা অধ্যায় নিয়ে যমুনা ওয়েবের পক্ষ থেকে তাই থাকছে বিশেষ আয়োজন। লিখেছেন মুনিম রাব্বী।
ঘোড়া ও তার সাথে একজন ঘোড়সওয়ারির ছবি আঁকা এমনিতেই কঠিন। কিন্তু ফ্রানৎস কাফকার আঁকা ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ারির ছবিটি অদ্ভুত রকমের সুন্দর। হ্যাঁ, কাফকা ছবি আঁকতেন।
জীবদ্দশায় কাফকা ছিলেন খ্যাতিহীন, তাকে তেমন কেউ চিনতো না। জানলে অবাক হবেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাফকা যতটুকু খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তা একজন চিত্রশিল্পী হিসেবেই। যদিও তিনি খ্যাতিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন না।

আঁকার প্রতি কাফকার মোহ কোন পর্যায়ের ছিল, তা এই ঘটনাটি থেকে বোঝা যায়। ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাগদত্তা ফেলিস বাউয়ারকে লেখা এক চিঠিতে কাফকা তার স্বপ্নের বর্ণনা দিয়েছিলেন। কাফকা স্বপ্নে দেখছেন– ফেলিস ও কাফকা হাতে হাত রেখে প্রাগের ওল্টাস স্কয়ারে হাঁটছেন। কাফকার কাছে স্বপ্নের সেই মুহূর্তটি ছিল ফেলিসের সাথে দেখা হওয়া প্রথম দিনটির মতো।
কাফকা স্বপ্নের সেই মুহূর্তটি বর্ণনা করার জন্য প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত কিন্তু কোনোভাবেই তা লেখার খাতায় ফুটিয়ে তুলতে পারছেন না। বিষণ্ন কাফকা প্রিয়তম ফেলিসকে লিখলেন– ’হাতে হাত না রেখে, চোখে চোখ না রেখেও তোমার এতো কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার অনুভূতি বর্ণনা করা কঠিন।’
এর পরের লাইনে কাফকার কাকুতি আঙ্গুরলতার মতো বেয়ে উঠলো– ‘আমি কীভাবে বোঝাব, স্বপ্নে তোমার সাথে আমি কী রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে হেঁটেছিলাম?’ কাফকা একটি বিকল্প উপায় খুঁজে ফেলিসকে আবার লিখলেন, ‘একটু অপেক্ষা করো লক্ষ্মীটি, এবার আমি স্বপ্নটি আঁকব।’
দ্বিধাগ্রস্ত কাফকা এভাবেই আঁকাকে আশ্চর্যজনকভাবে লেখার ওপরে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। কাফকার বিশ্বাস ছিল, লিখে যা তিনি প্রকাশ করতে পারছেন না, তা তিনি এঁকে বোঝাতে পারবেন।

কাফকার চিত্রগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়– মাত্র কয়েকটি স্ট্রোকের মাধ্যমে তিনি মানুষের মুখ ও দেহকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য সেই মুখের অভিব্যক্তি ও অঙ্গভঙ্গি কখনোই স্থির নয়। বরং চিত্রগুলো প্রায়শই গতিশীল, কখনও কখনও অতিমাত্রায় গতিশীল।
একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয়। কাফকার বেশিরভাগ চিত্রই মুক্ত ও ভাসমান। কাফকার ছবিগুলোকেও কাফকার মতো উদাসীন বলে মনে হয়। আত্ম-সন্দেহ, বিমূঢ়তা ও অস্তিত্বের হতাশায় জর্জরিত কাফকার ছাপ তার লেখাগুলোর মতো ছবিতেও স্পষ্ট।
‘কাফকায়েস্ক’ শব্দটা অনেকের কাছে পরিচিত। এর অর্থ করা যেতে পারে পরাবাস্তব বিমূঢ়তা কিংবা নৈরাজ্যের বোধ-জাগানো পরাবাস্তব কিছু অনুভূতি। কিন্তু কাফকার ছবিতে ‘কাফকায়েস্ক’ ব্যাপারটা সর্বতোভাবে হাজির নয়।
আমাদের জন্য তাই এমন সাধুসদৃশ অসুখী লেখক ও চিত্রকরকে পুরোপুরি অনুভব করা বেশ কঠিন। কাফকাকে নিয়ে সহজ উপসংহারে আসাটাও শক্ত।
/এএম



Leave a reply