
চীনের একটি সরকারি হাসপাতালে কম্পিউটারের স্ক্রিনে চীনা অক্ষরে ভেসে উঠল ‘আমি খেতে চাই’। এ শব্দগুলো ছিল অ্যামিওট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস (ALS) রোগে আক্রান্ত ৬৭ বছর বয়সী এক নারীর চিন্তা থেকে উদ্ভূত – যিনি কথা বলতে অক্ষম।
মার্চ মাসে বেইজিং রেডিও অ্যান্ড টেলিভিশনে প্রচারকৃত এটি ছিল ‘বেইনাও-১’ নামক মস্তিষ্ক-কম্পিউটার ইন্টারফেস (BCI) প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক ব্যবহারের অংশ, যা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন হলেও, চীন দ্রুত এতে অগ্রগতি করছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
চীনের ইনস্টিটিউট ফর ব্রেইন রিসার্চ (CIBR)-এর পরিচালক ও এই গবেষণার প্রধান বিজ্ঞানী লুও মিনমিন জানান, এই প্রযুক্তির চাহিদা ‘খুবই তীব্র’ এবং রোগীদের আবেদন ‘অভিভূত’।
লুও বলেন, ‘রোগীরা বলছেন এটি অসাধারণ, যেন তারা আবার তাদের পেশির ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছেন।পরীক্ষাগার পরিদর্শনের সময় তিনি আরও জানান, প্রযুক্তিটি রোগীদের মস্তিষ্ক থেকে সংকেত নির্ভুলভাবে বিশ্লেষণ করে তা পাঠ্যে রূপান্তর বা যন্ত্র চালনায় ব্যবহার করছে।
আগামী এক বছরে আরও ৫০ থেকে ১০০ রোগীর শরীরে এই চিপ স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই এই প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে যাক। যদি এটি নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হয়, তবে এটি বিশ্বব্যাপী চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতে পারে।’
২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত, ‘বেইনাও-১’-এর মোট পাঁচজন রোগীর শরীরে চিপ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে –যা ইলন মাস্কের নিউরালিঙ্ক প্রযুক্তির সংখ্যার সমান।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রতিষ্ঠান সিনক্রোন (যার বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জেফ বেজোস ও বিল গেটস রয়েছেন) ১০ জন রোগীর ওপর পরীক্ষা চালিয়েছে – ৬ জন যুক্তরাষ্ট্রে এবং ৪ জন অস্ট্রেলিয়ায়।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্স অধ্যাপক ম্যাক্সিমিলিয়ান রিসেনহুবার বলেন, চীন দেরিতে শুরু করলেও দ্রুত অগ্রগতি করছে। ‘চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এবং এখন কিছু ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকও হচ্ছে।’
প্রেসিডেন্স রিসার্চ-এর মতে, ২০২৪ সালে মস্তিষ্ক প্রযুক্তির বাজার ছিল প্রায় ২.৬ বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩৪ সালের মধ্যে এটি বেড়ে ১২.৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছে এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগত বিষয়ও।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বরাবরই দেশকে বিজ্ঞান ও অর্থনীতির শক্তিধর হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েছেন। মার্চে তিনি রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে লিখেন, প্রযুক্তি এখন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার ‘প্রধান রণক্ষেত্র’।
আলাদা পথ, কিন্তু একই লক্ষ্য
২০১৮ সালে বেইজিং সরকার ও স্থানীয় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় CIBR – ইলন মাস্কের নিউরালিঙ্ক প্রতিষ্ঠার প্রায় দুই বছর পরে। ২০২৩ সালে তারা নিউসাইবার নিউরোটেক নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, যা ‘বেইনাও-১’-এর মতো পণ্যের উন্নয়নে কাজ করছে।
ALS আক্রান্ত ওই নারী বছরের পর বছর কথা বলতে পারতেন না। লুও জানান, ‘তিনি জেগে ছিলেন, জানতেন কী বলতে চান, কিন্তু বলতে পারতেন না। এখন তিনি সহজ বাক্য বলতে পারছেন এই সিস্টেমের মাধ্যমে।’
BCI প্রযুক্তির সব গবেষককেই ঝুঁকি ও কার্যকারিতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান চিপটি ব্রেইনের সুরক্ষাকারী আবরণ ডিউরা ম্যাটারের নিচে স্থাপন করে, যা অধিক কার্যকর সংকেত দেয় – তবে এটি ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচার।
রিসেনহুবার বলেন, ‘বেইনাও-১ ডিউরার উপর থেকেও যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে, যা বেশ আশাব্যঞ্জক।’
বিশ্ব মঞ্চে চীনের আগ্রাসী পদক্ষেপ
যুক্তরাষ্ট্রে ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস প্রযুক্তির সূচনা ১৯৭০-এর দশকে। ওবামা প্রশাসনের ২০১৩ সালের ‘ব্রেইন ইনিশিয়েটিভ’ প্রজেক্টে ৩ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়। নিউ ইয়র্কভিত্তিক সিনক্রোন ২০২১ সালে প্রথম মানব পরীক্ষায় যায়। ২০২৪ সালে ইউসি ডেভিড হেলথ একটি ব্রেন চিপ তৈরি করে যা ৯৭% নির্ভুলতায় রোগীর চিন্তা থেকে ভাষায় রূপান্তর করে।
চীন ১৯৯০-এর দশকে মস্তিষ্ক প্রযুক্তিতে প্রবেশ করে এবং ২০১৬ সালের পাঁচ-সাল পরিকল্পনায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে। ‘ব্রেইন সায়েন্স চীনে নতুন, কিন্তু এর উন্নয়নের গতি অনেক দ্রুত,’ বলেন লিলি লিন, ২০২১-২৩ সালে চীনের শীর্ষ এক গবেষণাগারে কাজ করা সাবেক গবেষক।
২০২৩ সালে চীন প্রথমবারের মতো মস্তিষ্ক প্রযুক্তি গবেষণার নৈতিক নির্দেশিকা প্রকাশ করে। বেইজিং, সাংহাইসহ বড় শহরের স্থানীয় সরকারগুলো গবেষণা, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও বাণিজ্যিকীকরণে সহায়তা করছে।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপত্রে বলা হয়, চীনের BCI গবেষণা ‘যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সমতুল্য’ এবং ‘বিস্তৃত ব্যবহার ও কার্যকারিতার পথে বাধা দূর করতে কাজ করছে।’
চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা নয়, বরং ভিন্ন পন্থা
লুও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনও আক্রমণাত্মক ও অনাক্রমণাত্মক BCI-তে অগ্রগামী। চীনা চিপটি বৃহত্তর মস্তিষ্ক এলাকায় সংকেত গ্রহণ করে, তবে প্রতিটি নিউরনের জন্য কম নির্ভুলতায়।
লুও বলেন, ‘এই দুটি প্রযুক্তি একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। শেষ পর্যন্ত কোনটি রোগীর জন্য ভালো হবে তা সময়ই বলবে।’
সূত্র: সিএনএন নিউজ।
/এআই



Leave a reply