রাশেদ নিজাম ⚫
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় সামনে আসছে হৃদয় ভেঙে দেয়া কত ছবি। জুতা পরে থাকার একটি ছবিও দেখেছি কয়েকবার।
তখন আমির খান অভিনীত পি কে সিনেমার একটি ডায়ালগের কথা মনে পড়ছিল। সিনেমার শেষের দিকে পিকের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় তপস্যী জি। একপর্যায়ে আমির খান বলছিলেন, ইনসান নেহি, স্রিফ জুতা রাহে যায়ে গা (মানুষ না, শুধু জুতা থেকে যাবে)।
দেশে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটলেই বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয় নিজেদের সীমাবদ্ধতা।
প্রতিবার চোখে ভাসে, মারা যাওয়া মানুষগুলোর জুতার ছবি। কারও এক পাটি, কারও এক জোড়া। পোড়া, অর্ধপোড়া, একেবারেই না-পোড়া। সবই আছে, শুধু মানুষগুলো নেই।
কতভাবে মানুষ হারিয়ে যেতে পারে, এমন গবেষণার জন্য বাংলাদেশের চেয়ে ভালো প্লট বিশ্বে কোথাও নেই বলেই আমার বিশ্বাস।
বাচ্চার জন্য চকলেট কিনবেন বলে বাসা থেকে বেরোলেন। গলির মুখের রাস্তায় গাড়িচাপায় হারিয়ে গেলেন। সাদা চোখে একজন, আদতে কিন্তু বেশি। কারও সন্তান, কারও বাবা, কারও স্বামী, কারও ভাই।
নির্মাণাধীন ভবনের ইট পড়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও রাজধানীতে ঘটছে অহরহ। ওই যে হারিয়ে যাওয়ার নানা রকমফের।
ঢাকার আজিমপুরে দেয়ালচাপায় এবং কয়েক বছর আগে শাহজাহানপুরে পানির পাইপে পড়ে মারা যায় একই নামের দুই শিশু, জিহাদ।
অনিয়মিত বিরতিতে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িতে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা কয়েক বছর ধরেই হচ্ছে। কাছাকাছি সময়ে কয়েকটা হয়ে যাওয়ায় গণমাধ্যমে বেশি আলোচিত হয়েছে।
বছর দুয়েক আগে পল্টনে খোলা ম্যানহোলে পড়ে হারিয়ে যান এক পথচারী। দুইদিন পরে মেলে তার লাশ। ঘটনা শোনার পর সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে মনে হয়েছিল, এ কেমন মৃত্যু!
২০২১ সালে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর ভাগ্যেই জোটে একই পরিণতি। নালায় পরে মারা যান তিনি। কারণ, এ দেশে হারিয়ে যেতে কোনো কারণ লাগে না।
আরেক প্রকার হারিয়ে যাওয়া এ দেশে খুব আলোচিত ছিল। দুষ্ট লোকেরা এর নাম দিয়েছিল গুম। তবে এতক্ষণ যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো আর এই ‘গুম’ হয়ে হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য হলো— মরদেহ পাওয়া না-পাওয়া।
যারা অতি ভাগ্যবান সপ্তাহখানেক, মাসখানেক, ছয় মাস পরে তারা ফিরে আসেন। আর বেশিরভাগ আসলেই হারিয়ে যান। কেউ জানে না তারা কোথায়।
সাভারের স্পেকট্রাম থেকে শুরু হয়েছিল বড় ভবনধসের ঘটনা। রানা প্লাজার পর তো সংজ্ঞাই হারিয়েছে মানুষ মারা যাওয়ার। ১ হাজার ১০০ এর বেশি মানুষ!!!
সকালে কাজে গিয়েছিলেন। বৃদ্ধ মা, ছোট্ট সন্তান আশায় ছিল সন্ধ্যায় ফিরে আসবেন সবাই। কিন্তু নয়তলা সেই ভবন একেবারে মিশে গিয়েছিল। চাপা পড়া মানুষের সেই আর্তনাদ কাঁদিয়েছিল পুরো দেশবাসীকে। আন্তর্জাতিক মহলেও নাড়া ফেলেছিল রানা প্লাজার দুঃসহ ঘটনা। সেখানেও বহু মানুষের জুতা দেখেছিলাম। মানুষগুলো হারিয়ে গিয়েছিলেন, রয়ে গিয়েছিল জুতা।
সেই পুরোনো কথার মতো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। এবার তো শিশুরা পুড়েছে, শিক্ষাটা নেয়া দরকার না?
লেখক: বিশেষ প্রতিবেদক, যমুনা টেলিভিশন

