মেসির ফুটবল সৌরভ কখনও ফুরোবার নয়

|

মাহমুদুল হাসান ইমন ⚫ 

‘ফিনিশ ধারাভাষ্যে আর্জেন্টিনা-ভেনেজুয়েলা ম্যাচ দেখছিলাম। লিওনেল মেসির জোড়া গোলের পর ধারাভাষ্যকার কণ্ঠ ফুলিয়ে বললেন– মেসিন ইয়াল্কাপাল্লো এই লপু কসকাআন কাতোয়া। মেসি অন নাউতিত্তাভা। অর্থাৎ মেসির ফুটবল কখনও ফুরোবার নয়। মেসি উপভোগ্য।’ —বলছিলেন এক আর্জেন্টাইন ভক্ত।

লেখক আর্জেন্টাইন ভক্ত নয়, তবে হলুদিয়া ফুটবলের রঙে রাঙানো হৃদয় নিয়ে ভালোবাসে ফুটবলকে। সেখান থেকেই হয়তো জন্ম নিয়েছে লিওর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তাই নিজ মাটিতে মেসির ‘লাস্ট ড্যান্সের’ মুহূর্ত যেন তার হৃদয়েও খেলে গেছে মায়ার ঢেউ।

সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ৭৫ মিনিটে মাঠে নেমেছিলেন। আর্জেন্টিনা ততক্ষণে ৩-০। কার্লোস তেভেজের পাস থেকে ৮৮ মিনিটে বিশ্বকাপের অভিষেকেই গোল করেন মেসি।

সেই ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে তিনি প্রথমবারের মতো বিশ্বমঞ্চে নজর কেড়েছিলেন। সর্বকনিষ্ঠ আর্জেন্টাইন হিসেবে বিশ্বকাপে গোল করার কৃতিত্ব অর্জন দিয়ে শুরু, এরপর ২০০৯ সালে বার্সেলোনার জার্সিতে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে গোল। ২০১২ সালে রেকর্ড ভাঙা ৯১ গোলের জাদু, যা এখনও ফুটবল ইতিহাসে স্বর্ণখচিত।

২০১৪ বিশ্বকাপে ট্রফি জয়ের খুব কাছে গিয়েও হারের দুঃখ তো ভোলবার নয়। শিরোপা হাতে না পেলেও তার দৃঢ়তা ও খেলাটার প্রতি প্যাশন ফুটবলপ্রেমীদের মনে আজও অম্লান।

২০০৯ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে কিংবদন্তি স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে দলের জয় নিশ্চিতকারী গোলটি করেছিলেন মেসি। ম্যাচের ৭০ মিনিটে জাভির ক্রসে তিনি মাথা ছুঁয়েছিলেন বিশাল এক লাফ দিয়ে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর বিপক্ষে এটি ছিল মেসির প্রথম ম্যাচ।

এরপর এলো শিরোপা উঁচিয়ে ধরার ক্ষণ। ২০২১ কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনার জার্সিতে ট্রফি জয়ের মুহূর্ত এক অবিস্মরণীয় ছবির জন্ম দেয়। পরের বছর হাতে ধরা দেয় আরাধ্য বিশ্বকাপ, হয় স্বপ্নসফল পরিণতি। সব মিলিয়েই তো মেসি, অনন্য কিংবদন্তি।

ফুটবলকে যিনি ভালোবাসেন, তার কল্পনাতে মেসির সৌরভ কখনোই ফুরোবার নয়, তিনি থাকবেনই। ফুটবলের এই ‘রত্নে’র নব্বই মিনিটে যেন সৃষ্টি হতো নতুন নতুন গল্প।

মেসির চোখধাঁধানো প্রতিটা ড্রিবল কীভাবে ভুলে থাকবেন ফুটবলপ্রেমীরা? তার প্রতিটা পাস যেন অনবদ্য এক শিল্পীর স্পর্শ থেকে আগত, গোলের আগ মুহূর্তে নিখুঁত নিয়ন্ত্রণই তাকে দিয়েছে জাদুকরের মর্যাদা। দলের প্রতি নিষ্ঠা, ফুটবলের প্রতি অনুরাগ, সব মিলিয়েই মেসি ফুটবলের কিংবদন্তি। ফুটবলের মহাপুরুষের মর্যাদা যেন তার জন্যই অবধারিত।

ফুটবলের এই দার্শনিক আজ যখন মাঠে নামলেন, তখন বাতাসে তুমুল উল্লাস, দর্শকের চোখে জ্বলজ্বলে ভালোবাসা, প্রতিটি দিক থেকে শোনা যাচ্ছিল চিয়ারের মৃদু শব্দ। সমর্থকেরা ধরেছিল গান— ‘লিও মেসি আছে পাশে, পুরো পথ আমরা পাড়ি দেব একসাথে।’

আর্জেন্টিনার মাটিতে নিজের শেষ ম্যাচে মনুমেন্তাল স্টেডিয়ামে সন্তানদের সঙ্গে লিওনেল মেসি।

‘নিজের’ মানুষের সামনে আর কখনও আলবিসেলেস্তের জার্সি গায়ে চাপানো হবে না মেসির। এদিন গ্যালারিতে উৎসবের ঢাকে তাই বিদায়ের রাগিনীর সুরও বেজেছে। দর্শকের কণ্ঠে বেজেছে— ‘ওলে, ওলে, ওলে… মেসি, মেসি, মেসি!’

আর্জেন্টাইনদের জন্য এই দিনটি কেবল একটি ম্যাচ নয়, ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়েই রয়ে যাবে। মেসির প্রতিটি মুভমেন্ট যেন আজ কথা বলছিল। যেন বলছিল— ‘আমার সময় ফুরোলো, আমায় মনে রেখো।’

আজ যে মাটি থেকে বিদায় নিলেন, এই মাটিতেই সৃষ্টি হয়েছিল একজন ‘মেসি’। স্বপ্নের বীজ রোপন করে গল্পের সেই যে শুরু, আজ তার হলো অবসান। ফুটবল জাদুকরের আর্জেন্টিনায় শেষ অধ্যায় লেখার পাশাপাশি তার প্রতিটা কারিকুরি কিংবা গোল— সবই যেন স্থির হয়ে উঠলো ইতিহাসের পাতায়। দর্শকেরা হতবাক হয়ে দেখছিলো, তারা জানতো— শেষ হতে যাচ্ছে ‘মেসি যুগের’। তাই আজকেই মুহূর্তগুলো হয়ে উঠছিল দারুণ উপভোগ্য।

মেসি যে ধারার ফুটবলার, তাকে নিয়ে আসলে লিখে শেষ করা বা বোঝানো সম্ভব নয়। তবে এতোটুকু বোঝা গেল— মনুমেন্তাল স্টেডিয়াম থেকে কেবল একজন খেলোয়াড় বিদায় নেননি, বিদায় নিয়েছে এক আবেগের সহস্রধারা। মেসি গত দুই দশক ফুটবলকে নিছক খেলা নয়, বরং শিল্প, গল্প ও অনুভূতির এক অফুরন্ত উৎসে পরিণত করেছেন।

বিশ্বকাপ শিরোপা হাতে লিওনেল মেসি। ছবি: রয়টার্স

মাঠে মেসির প্রতিটা পদক্ষেপ, প্রতিটা মুভমেন্ট ফুটবলপ্রেমীদের মনে অনন্ত স্মৃতির মতো বাস করবে। আর্জেন্টিনার মাটিতে তার শেষ গোলটা ‘শেষ সিগনেচার’ হয়ে ফুটে থাকবে কোটি ভক্তের হৃদবাগানে। কারণ ‘মেসিন ইয়াল্কাপাল্লো এই লপু কসকাআন কাতোয়া’। কারণ মেসির ফুটবল সৌরভ কখনও ফুরোবার নয়..


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply