Site icon Jamuna Television

পলাশবাড়ীতে সুদখোর মহাজনের জালে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার

জিল্লুর রহমান পলাশ, গাইবান্ধা
আধুনিক যুগে এসেও গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে চলছে সুদখোর মহাজনের রমরমা দাদন ব্যবসা। চড়া সুদের জালে বন্দি হয়ে নিঃস্ব হয়েছেন নিম্ন আয়ের শতাধিক পরিবারের মানুষ। দাদনের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে ঘরের আসবাবপত্র গরু, ছাগল ও ভ্যান রিকশা নিয়ে যায় মহাজন । মারধর ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অনেকে। এমনকি মিথ্যা মামলায় হয়রানী শিকার ও ভিটেমাটি ছেড়ে পরিবার নিয়ে পালিয়েছে বেশ কয়েকটি পরিবার।

স্থানীয়দের অভিযোগ, পলাশবাড়ীর উপজেলা মৎসজীবী লীগের সভাপতি মনিরুজ্জামান রাসেল ও তার পরিবার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সংস্থার নামে সমিতি গড়ে তুলে দীর্ঘদিন ধরে সুদের ব্যবসা চালিয়ে আসছেন।

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মহদীপুর ইউনিয়নের দূর্গাপুর ও নয়াবাজার গ্রাম। এই দুই গ্রামের অধিকাংশ মানুষেই নিম্ন  আয়ের খেটে খাওয়া দিনমজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। জীবিকার প্রয়োজনে দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয় তাদের। তবে ঋণের টাকায় যে আয় হয় তার প্রায় সবটাই চলে যায় দাদন ব্যবসায়ীর পকেটে।

গ্রামের সহজ-সরল ও খেটে খাওয়া শতাধিক মানুষ বিভিন্ন অংকে চড়া সুদে ঋণ নেয় স্থানীয় মৎসজীবী লীগের সভাপতি মনিরুজ্জামানের পরিচালিত ‘প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সংস্থা’ থেকে। ১ হাজারে ২০০ লাভে দৈনিক ও সাপ্তাহিক চুক্তিভিত্তিক ঋণ নেয়ার সময় সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিতে হয় তাদের। দিন বা সপ্তাহে কিস্তির টাকা দিতে না পারলে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে সুদ। সেই জালে জড়িয়ে পড়েছেন গ্রামের অসংখ্য মানুষ। টাকা পরিশোধ করলেও এখন সইছে অত্যাচার।

ভুক্তভোগী সাহেদ মিয়ার অভিযোগ, অভাবের কারণে রাসেলের কাছে দৈনিক কিস্তিতে ১০ হাজার টাকা নেই। কিছুদিন ঠিকভাবে কিস্তি দেয়ার পর হঠাৎ কিস্তি দিতে পারিনি। কিস্তির টাকা না পেয়ে রাসেল নানাভবে তাকে হুমকি দিতে থাকে। এক পর্যায়ে রাসেলের মা তাকে পথে আটক করে মারধর করে।

মিজবুল আকন্দ নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, প্রথমে রাসেলের কাছে ছয় হাজার টাকা নেই। দুই মাস কিস্তি দিয়ে ছয় হাজার টাকার লাভ দেই এক হাজার দুইশ টাকা। পরবর্তীতে আবারও ছয় হাজার টাকা নেই। কিছুদিন কিস্তি দিতে না পারায় রাসেলের মা আরজিনা বেগম তাকে বেদমভাবে মারধর করে আহত করে। মারধরের ঘটনায় চারদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি।

অলি নামের এক দরিদ্র অসহায় দিনমজুর বলেন, ‘চড়া সুদে লাভের টাকা নিয়ে যা আয় করি তার বেশি ভাগেই দিতে হয় সুদখোর রাসেলকে। সমস্যা থাকায় কিস্তি দিতে পারিনি। এজন্য রাসেল তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মারধর করে এবং তার কাছে সুদে আসলে টাকা আদায় করে’।

আঙ্গুরা নামে এক গৃহবধূ বলেন, ‘ব্যবসার জন্য স্বামীসহ রাসেলের কাছে ৫০ হাজার টাকা নেই। সুদে আসলে তাকে প্রায় দেড় লাখ দেই। এরপর তার কাছে আর টাকা না নেয়ায় বারবার রাসেল তাদের চাপ দেন। রাসেল হুমকি দিয়ে বলেন, কেন টাকা নিবি না ব্যবসা করবি কি দিয়ে। এভাবে টাকা নিলেও হুমকি দেয় না নিলেও হুমকি দেয় রাসেল’।

এদিকে রাসেল ও তার পরিবার একের পর এক মানুষকে আটক করে টাকা আদায় ও নির্যাতন করে আসছেন। তাদের কবল থেকে মুক্তি ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে সম্প্রতি মানববন্ধন করেছেন এলাকাবাসী।

এ বিষয়ে মহদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম বলেন, নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে সমিতির নামে সুদ ব্যবসার বিষয়ে উদ্বিগ্ন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও। নিরীহ মানুষকে ফাঁসাতে রাসেল বাড়ি ডাকাতির মিথ্যা অভিযোগ করছেন। যা তদন্তে ইতোমধ্যে মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে। তবে এ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ ও প্রশাসনের নিকট দাবি জানান তিনি।

পলাশবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেজবাউল হোসেন বলেন, সমবায় সমিতির বাইরে এবং অনুমোদন ছাড়া কেউ ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। তারপরেও কেউ সমিতির নাম ব্যবহার বা ব্যক্তিগত সুদ ব্যবসা-ঋণ কার্যাক্রম চালালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

সুদ ব্যবসা ও সুদখোর মহাজনের অত্যাচারের বিষয়ে অবগত আছেন আইনশৃঙ্খলা বাহীনি। অভিযুক্ত রাসেলের বাড়ি ডাকাতির অভিযোগও মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে। তাছাড়া তাদের সুুদের ব্যবসার অভিযোগের প্রাথমিক তদন্তের সত্যতাও পাওয়া গেছে। দ্রুতই এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান পলাশবাড়ী থানার ওসি হিপজুর আলম মুন্সি। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হয়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে রাসেল বলেন, সমিতি বা দাদন ব্যবসার সঙ্গে তিনি ও তার পরিবার জড়িত নয়। মুলত তার বাড়ি ডাকাতির ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে এবং তাকে হেয় করতে তার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা অভিযোগ তুলছেন স্থানীয়রা।

 

Exit mobile version