Site icon Jamuna Television

কুড়িগ্রামে হন্যে হয়ে বাবা-মাকে খুঁজছে সুইজারল্যান্ড প্রবাসী রওফি

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ

কুড়িগ্রামের উলিপুর ও চিলমারীতে হারানো বাবা-মায়ের খোঁজে হন্যে হয়ে পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সুইজারল্যান্ড প্রবাসী রওফি। স্বামী ও প্রবাসী বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান করেও কোন সূত্র না পেয়ে হতাশ তিনি। তারপরও মনের আশা হয়তো ফিরে পাবেন হারানো বাবা-মাকে।

খোদেজা রওফি জানান, দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে অপেক্ষার প্রহর গুণছেন তিনি। বিদেশ বিভুঁইয়ে মানুষ হয়েছেন দত্তক সন্তান হিসেবে। কোন কিছুর ঘাটতি রাখেননি সেই বাবা-মা। তারপরও কোথাও যেন একটু রক্তক্ষরণ! চিনচিনে ব্যাথা মনে দাগ বসিয়ে দিয়েছিল। সংসার-স্বামী-সন্তানকে নিয়ে সুখে থাকলেও একটা সুতোর টান অনুভব করতেন মনের খাঁচায়। বড় হয়ে যখন জানলেন তার দেশ সুইজারল্যান্ড নয়। জন্ম বাংলাদেশে। তখন থেকেই খচখচ করছিল মনটা। এক সময় স্বামীকে বলেই ফেললেন আরাধ্য কথাটি। স্বামীও রাজি হলেন তার কথায়। তারপর বাংলাদেশে খুঁজতে এলেন হারিয়ে যাওয়া বাবা-মায়ের খোঁজে।

তার সফরসঙ্গি ও অন্যান্য লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে সাড়ে ৩ বছর বয়সি খোদেজাকে উলিপুর উপজেলার থেতরাই বাজারে কাঁদতে দেখে পার্শ্ববর্তী চিলমারী উপজেলায় অবস্থিত বেসরকারি শিশু সংগঠন টেরেডেস হোমস এর একটি নোঙ্গরখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ছিল সে। এরপর সুইজারল্যান্ডের রওফি পরিবার তাকে দত্তক নেয়। ছোট্ট বেলার স্মৃতি একটি সাদাকালো ছবি নিয়ে সে নতুন বাবা-মায়ের সাথে পাড়ি দেয় জেনেভা শহরে। সেখানেই সন্তান হিসেবে পরিচতি লাভ করেন। পড়াশুনা শেষ করে জেনেভার সাইকেল ডেলা গোলেহে স্কুলের শিক্ষক হিসেবে ২০০১ সাল থেকে কাজ করছেন। মা-বাবা হারানোর সময়ের স্মৃতি হিসেবে তার কোন কিছু মনে নেই। তবে তিনি জানান এতটুকু মনে রয়েছে আমি তখন অন্য কোন শহরে চলে এসেছি। এতদিন পরে আমি আমার নিজের জন্মভূমিতে এসেছি শুধুমাত্র আমার প্রকৃত মা-বাবা’র খোঁজে। কিন্তু আমি তাদের নাম-ঠিকানা কিছুই জানিনা। আমার কাছে শুধু আমার নিজের একটি ছোটবেলার সাদাকালো ছবিই আছে। শেষ বয়সে এসে যদি আমার মা-বাবা এবং বংশধরদের খুঁজে পাই। আমার থেকে বড় খুশি আর কেউ হবে না।

খোদেজা সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় পড়াশোনা শেষ করে সেখানকার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার জিইয়াস মরিনোকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে ৫ বছরের ইলিয়াস নামের একটি পূত্র সন্তান রয়েছে।

খোদেজার সফর সঙ্গি হিসেবে ইনফ্যান্টস ডু মনডে’র কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর রাকিব আহসান জানান, প্রাথমিকভাবে আমাদের সোর্সদের কাজে লাগিয়ে আমরা খোদেজার মা-বাবা এমনকি তার স্বজনদের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু কেউ কোন তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেনি। তবে কেউ যদি কখনও খোদেজার মা-বাবা’র পরিচয় দাবী করেন সে বিষয়ে আমরা সঠিক তথ্য উপাত্তসহ ডিএনএ টেষ্ট করিয়ে শতভাগ নিশ্চিত হবো। কেননা আমরা চাই না এই সময় এসে খোদেজা কোন প্রতারণার শিকার হোক।

অপর সফর সঙ্গি জেনেভা বাংলা পাঠশালার পরিচালক ও সুইস বাংলাদেশ কালচারাল এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক বলেন, খোদেজার সাথে আমার পাঠশালাতেই পরিচয় হয়। সেখানে আলাপচারিতার তার শৈশবের কথা জানালে আমিও তার মা-বাবা’র খোঁজে এসেছি। কিন্তু বিষয়টি খুবই জটিল। কেননা কোন ডকুমেন্টস আমাদের হাতে নেই। কিন্তু তারপরেও যদি মিরাকল কিছু ঘটে।

স্থানীয় এনজিও কর্মী নুরুল হাবীব পাভেল জানান, সেই সময় কুড়িগ্রামে খুবই দুর্ভিক্ষ ছিল। তখনকার পরিস্থিতি দেখে চিলামারীর নুরন্নবী চৌধুরী, দেলোয়ার মাস্টার, ছমচ হাজীসহ অনেকেই একটি নোঙ্গর খানা খোলেন। পরবর্তিতে টিডিএইচ নোঙ্গর খানাটি নেন। সেখানে ১২শ শিশু ছিল নোঙ্গর খানায়। প্রতি ৫০জন শিশুকে দেখার জন্য একজন করে টিম লিডার ছিল। খোদেজার টিম লিডার আনিছুর ছিলেন। সে খোদেজার ছবি দেখে চিনতে পেরেছে। কিন্তু তার মা-বাবা’র বিষয়ে কিছুই বলতে পারেনি। তিনি আরো জানান ১৯৭৮ সালে আমার জানামতে ৩৬জন এতিম শিশুকে অনেক বিদেশী দত্তক নিয়েছিল। খোদেজার সাথে তার সমবয়সী পিপিজ এবং কুরানী নামের আরো দুটি শিশু বিদেশে গিয়েছিল। সেই সময় টিডিএইচ-এ যেসব শিশু বড় হয়েছিল তাদের মধ্যে যাদের মাতা-পিতা মারা গেছে তাদের কেই শুধু দত্তক দিয়েছে। আর যাদের পিতা মাতা ছিল তাদেরকে স্বাবলম্বী করে দেয়া হয়। আর খোদেজাকে রাস্তা থেকে নিয়ে আসায় তার পিতা-মাতা সম্পর্কে কেউ কোন তথ্য দিতে পারছে না।

Exit mobile version