Site icon Jamuna Television

সঙ্গীতের জাদুকর সাধক তানসেন

ইব্রাহিম খলিল

সংগীতের রাগের মূর্ছনার প্রবল উত্তাপে সাধকের সামনে থাকা নিষ্প্রাণ পাদপ্রদীপগুলো ধপ করে জ্বলে উঠলো কিংবা সুরের গভীর টানে আকাশ জুড়ে জমে গেল কালো মেঘ আর মেঘ ভেদে নেমে এলো অঝোর ধারার বৃষ্টি। সংগীত আর সুরের এমন জাদুময়তার কথা মনে আসলে একজনের নামই চিত্তকে নাড়া দেয়, আর তিনি হলেন ভারতের কিংবদন্তী সঙ্গীত সাধক মিয়া তানসেন। যিনি ছিলেন সম্রাট আকবরের সভার শ্রেষ্ট গায়ক।

সঙ্গীত ভালোবাসেন আর তানসেনের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সংগীত শিল্পী ও কবি মুকুন্দ মিশ্রা এবং তার স্ত্রী বাস করতো ভারতের মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়ার বেহাটে। তানসেন ছিল তাদের একমাত্র সন্তান। ছোটবেলায় খুব দুরন্ত স্বভাবের ছিল তানসেন। প্রায়ই সে বাড়ির পাশের বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াত এবং বনের পশুপাখিদের ডাক নকল করে ডাকতো নিখুঁতভাবে। একদিন বিখ্যাত সংগীত সাধক স্বামী হরিদাস তার দল নিয়ে সেই বনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। বনমধ্যে ক্লান্ত হয়ে দলটি একটি বিশাল গাছের ছায়ায় বসে। এ সময় আড়াল থেকে তানসেন তাদের দেখতে পেলো। বনের মধ্যে অচেনা মানুষ, হঠাৎ তাদের ভয় দেখানোর দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল তানসেনের মাথায়। সে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেল এবং সেখান থেকে বাঘের গর্জনে দিতে লাগলো। ভয় আতঙ্কে গানের দলটি দিক বেদিক ছুটোছুটি শুরু করলো। কিন্তু স্বামী হরিদাস তাদের ডাকলেন অভয় দিলেন বাঘ সবসময় ভয়ঙ্কর নয়। এর মধ্যে দলের একজন গাছের আড়ালে তানসেন কে দেখে ফেললো। আড়াল থেকে তাকে ধরে এনে বললো, গুরু এখানে কোন বাঘ নেই আছে শুধু এই দুষ্টু বালকটি। স্বামী হরিদাস তাকে কোন শাস্তি দিলেন না, তিনি তানসেনকে তার বাবার কাছে নিয়ে গেলেন এবং বললেন আপনাদের সন্তান খুবই দুষ্টু এবং একই সাথে সে খুব মেধাবীও, আমি মনে হয় আমি তাকে ভালো সংগীত শিল্পী হিসেবে তৈরি করতে পারবো।  তানসেন যখন সংগীত শেখার জন্য গৃহত্যাগ করেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র দশ বছর এরপর তিনি স্বামী হরিদাসের কাছ থেকে ১১ বছর সংগীত শিক্ষা লাভ করেন এবং নিজেকে একজন বিখ্যাত সংগীত সাধক হিসেবে তৈরি করেন।

প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তানসেনের মা বাবা মারা যায়। তার বাবা মুকুন্দ মিশ্রার শেষ ইচ্ছা ছিল তানসেন যেন গোয়ালিয়ার আরেক বিখ্যাত সংগীত সাধক মোহাম্মদ গউছের সাথে দেখা করেন। মোহাম্মদ গউছ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক একজন ব্যক্তি। মোহাম্মদ গউছের সাথে অবস্থান করার সময় প্রায়ই তিনি তানসেনকে রানী মৃগনয়নীর সভায় নিয়ে যেতেন। যে নিজেও ছিল একজন বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ। সেখানে তানসেনের সাথে পরিচয় হয় সভার হোসাইনী নামে এক নারীর এবং তানসেন তার সাথে বিবাহে আবদ্ধ হন। হোসাইনি নিজেও স্বামী হরিদাসের শিষ্যাত্ব গ্রহণ করেন।  তানসেন এবং হোসাইনীর ছিল পাঁচ সন্তান, যারা প্রত্যেকে বিশেষভাবে সংগীত অনুরাগী ছিল। তানসেনের সংগীত খ্যাতি এর মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে তানসেন সম্রাট আকবরের সভায় সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। আকবর তানসেনের সংগীতে সবসময় মনমুগ্ধ থাকতেন, তিনি তানসেনকে তার সভায় যোগদান করার অনুরোধ জানান।

তানসেন সম্রাট আকবরের সভায় যোগদান করেন ১৫৫৬ সালে। তার সংগীত প্রতিভা দিয়ে তিনি স্বল্প সময়ে আকবের খুব পছন্দের ব্যক্তিতে পরিণত হন। তিনি তানসেনকে রাত দিন যেকোনো সময় সংগীত সাধনার অনুমতি দেন। মাঝে মাঝে তিনি তানসেনের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতেন শুনতেন তানসেনের সংগীত সাধনা এবং মুগ্ধ হতেন। তিনি তানসেনকে অনেক উপহারও দিতেন। ভূষিত করেন নবরত্ন হিসেবে।

বিপত্তি বাধে অন্য জায়গায়, রাজসভার কিছু সভাকর তানসেনের ব্যাপারে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। তারা তানসেনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। এদের মধ্যে শওকত মিয়া নামে একজন সভাকর একটি ধুরন্ধর বুদ্ধি বের করে। তিনি তানসেনকে দিয়ে কঠিনতম জীবন হানিকর রাগ “রাগদিপক” গাওয়ানোর পরার্মশ দেন। কিন্তু এটা কিভাবে তানসেনকে হত্যা করবে অন্য ষড়যন্ত্রকারীদের এমন প্রশ্নে শওকত মিয়া বলেন, যদি রাগদীপক ভালোভাবে গাওয়া হয় তবে এটা গায়কের চারপাশের পরিবেশনে ভীষণ উত্তপ্ত করে দেবে এবং স্বয়ং গায়ককে আগুনে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দেবে। তানসেন অনেক বড় সংগীত সাধক, সে যদি রাগদীপক গায় তবে সে মরবে এবং আমরা আমাদের ইচ্ছা পূর্ণ করতে পারবো।

শওকত মিয়া সম্রাট আকবরের কাছে গেলেন তাকে বললেন, আমরা মনে করি না তানসেন অনেক বড় সংগীত সাধন। যদি তাই হয় তবে তাকে রাগদীপক গাইতে বলেন। কারণ একমাত্র বিখ্যাত সাধকরাই রাগদীপক সঠিকভাবে গাইতে পারে। আকবর বললেন, অবশ্যই সে এটা গাইতে পারবে, তানসেন যেকোনো কিছু গাইবার ক্ষমতা রাখে।

সম্রাটের প্রস্তাবে তানসেন আতঙ্কিত বোধ করলেন কিন্তু তিনি আকবরের কথা অমান্য করলেন না। তিনি এটা গাইবার প্রস্তুতির জন্য কিছুদিন সময় নিলেন সম্রাটের কাছ থেকে। এরপর তানসেন বাড়িতে গেলেন, এরকম বিমর্ষ আর চিন্তিত তাকে আগে কখনো দেখা যায়নি। তিনি স্ত্রীকে বললেন, আমি এই রাগ গাইতে পারবো কিন্তু এর ফলে যে তাপ উৎপন্ন হবে সেটা যে শুধু  আমার সামনে থাকা প্রদীপগুলোকে জ্বালিয়ে দেবে তা নয় এটা আমাকেও পুড়ে ছাই করে দেবে। তবে তিনি একটা বুদ্ধি বের করলেন, তিনি বললেন, যদি একই সময়ে “রাগমেঘ” গাওয়া হয় সঠিকভাবে তবে সেটা বৃষ্টি নামাতে পারবে এবং সেটা উত্তাপ কমিয়ে দিয়ে পুড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেবে। আমার মেয়ে স্বরস্বতী এবং তার বান্ধবী রুপোয়াতী এই কাজটি করতে পারে।

তিনি এই দুই কন্যাকে রাগমেঘ গাওয়া শেখালেন। দুই সপ্তাহ দিন রাত টানা তারা এই রাগ চর্চা করলো। তানসেন তাদের বললেন, তোমরা প্রদীপগুলো জ্বলে ওঠার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে যখনই প্রদীপগুলো জ্বলে উঠবে তোমরা রাগমেঘ গাওয়া শুরু করবে।

কিংবদন্তি আছে পূর্ব নির্ধারিত দিনে তানসেন রাগদীপক গাওয়ার জন্য মঞ্চে আসলেন। সারা শহরের সব লোক জমায়েত হলো তানসেনের গান শুনবার জন্য। লোকদের ভীড় ঠেকানোর জন্য নিরাপত্তাবাহিনী নিযুক্ত করা হলো। আসলেন সম্রাট আকবরও আর তানসেনে প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ন সভাকররাও। মঞ্চে উপবিষ্ট হয়ে তানসেন তার জাদুকরী কণ্ঠে গাওয়া শুরু করলেন রাগদীপক। আর মঞ্চের আরেক প্রান্তের বসলেন তার কন্যাদ্বয় স্বরসতী ও রুপওয়াতী। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুরু করলো রাগদীপক। সময় বাড়ার সাথে সাথে তানসেনের কণ্ঠে বাড়তে থাকে রাগের উচ্চাঙ্গ, শানিত হতে থাকে তার কণ্ঠ। এমন রাগ সাধনের প্রভাবে উষ্ণ হতে থাকে চারপাশের বাতাসও। আশেপাশের লোকজনদের মধ্যে গুমোট অস্বস্তি সৃষ্টি হতে থাকে, তাদের মধ্যে হাসফাস শুরু হয়ে যায়। গাছের পাতা শুকিয়ে যায় সেগুলো মাটিতে ঝরে পড়ে। সংগীত চলতে থাকে আরো উচ্চাঙ্গে, উষ্ণতা সহ্য করে না পেরে পাখিরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মৃত হয়ে। প্রবল উত্তাপে ফুটতে থাকে নদীর পানি। প্রবল বিষ্ময়ে মানুষের চোখে পানি চলে আসে যখন তারা দেখে তানসেনের গায়কিতে সৃষ্ট প্রবল উত্তাপ সামনে থাকা নিষ্প্রাণ প্রদীপগুলোকে ধপ করে জ্বালিয়ে দেয় উজ্জ্বল শিখায়।

ঠিক সেই সময়ে সাথে সাথে স্বরসতী এবং রুপোয়াতী গাইতে শুরু করে রাগ মেঘ। তাদের সুরের মোহনায় নিবিষ্ট সাধনায় কালো মেঘ জমতে থাকে আকাশে। আর সেই মেঘ ভেদ করে মুহুর্তেই নেবে আসে প্রশান্তির বৃষ্টি জলধারা। সংগীতের এমন জাদুময়তা আর সাধনা দেখে হতবিহ্বল আর প্রবল চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় মানুষের মাঝে। আর অগ্নি উত্তাপে পুড়ে ছাই হওয়া থেকে বেঁচে যান তানসেন।

এই ঘটনার পর ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন তানসেন। সম্রাট আকবর খুবই বিনীত দুঃখ প্রকাশ করেন তানসেনের কাছে যে তিনি তাকে বাধ্য করেছিলেন এমন একটি আত্নবিধ্বংসী কাজ করার জন্য। এরপর আকবর কঠোর শাস্তি দেন শওকত মিয়া সহ সেই সব প্রতিহিংসাপরায়ণ সভাকরদের। যেদিন তানসেন ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন সেদিন পুরো শহর আনন্দের বন্যায় ভেসে গেল।

তানসেন সম্রাট আকবরের সভার গায়ক হয়ে থাকলেন ১৫৮৫ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তিনি সংগীতের বহু নতুন নতুন রাগ সৃষ্টি করেন। তানসেনের সমাধি রয়েছে ভারতের গোয়ালিয়াতে। আর এই জায়গাটি সংগীত সাধকদের জন্য তীর্থস্থান।

লেখক : সাংবাদিক
khalilnews9@gmail.com

Exit mobile version