Site icon Jamuna Television

সিরাজগঞ্জে বেড়েই চলছে অটিজম শিশুর সংখ্যা

গোলাম মোস্তফা রুবেল, সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জের তাঁত শিল্প সমৃদ্ধ এলাকা গুলোতে অটিষ্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের হার ক্রমশ বাড়ছে। অপরিকল্পিত ভাবে তাঁত ও তাঁত শিল্পে ব্যবহৃত মারাত্বক রাসাায়নিক পদার্থ ক্রমশ  ভুগর্ভস্থ পানির স্তরে মিশে গিয়ে তা দূষিত করছে। আর সেই দূষিত পানি নলকুপের মাধ্যেমে তুলে পান করছে এলাকাবাসী। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক হুমকি স্বরুপ এই দূষিত পানি পান করার কারণেই  মাতৃগর্ভে জন্ম নিচ্ছে অটিষ্টিক শিশু। এছাড়া নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এই এলাকার মানুষেরা। গত একদশক ধরে বিষয়টি ব্যাপক ভাবে আলোচিত হলেও সমস্যা সমাধানে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

তাঁত ও বস্ত্রশিল্পের জন্য দেশের অন্যতম একটি জনপদের নাম সিরাজগঞ্জ জেলা। তাঁত শিল্পের জন্য ব্যবহৃত সুতা রং এর বর্জ্য মিশ্রিত বিষাক্ত পানি এলাকার জলশায় গুলোতে ফেলা হচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরেই এই বর্জ্য ফেলার কারণে জলাশয় ভর্তি হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে কারখানার মালিকেরা পাইপ দিয়ে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ভুগর্ভস্থ পানির স্তরে মিশিয়ে দিচ্ছে। এতে ভুগর্ভস্থ পানির স্তর মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ছে। এসব এলাকার নলকুপ চাপলেই এখন দূষিত পানি উঠে আসছে। আর এরকম ভয়ানক রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত পানি প্রতিনিয়ত পান করছে এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। চিকিৎসকদের মতে এমন দূষিত পানি পান করায় গর্ভবতী মায়েদের গর্ভে জন্ম নিতে পারে অটিষ্টিক শিশু।


যমুনা টিভির Investigation 360 Degree টিম এ অঞ্চলের বেশ কিছু নলকুপের পানির নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করেছে। একই সাথে সিরাজগঞ্জ জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরও রাজশাহী জোনাল ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে। পরীক্ষায় পানিতে মারাত্মক ডিজল অক্সিজেন, মেগানিস, ফসফেট, শিশা, মাত্রাতিরিক্ত আয়রন ও আর্সেনিক পাওয়া গেছে। যা মানব শরীরের জন্য অত্যন্ত হুমকি স্বরুপ বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

বেলকুচি উপজেলার গাড়ামাসি গ্রামের শহিদুল্লাহ খান ও তার স্ত্রী নাজমা বেগম জানান, তাদের বাড়ীর চার পাশে সুতা রং এর ডাইং ও প্রসেস মিল রয়েছে। এসব মিলের বর্জ্যযুক্ত রঙ্গিন পানি তার বাড়ীর চাপকলে উঠে আসে। এসব পানি দিয়ে নানা রকম গন্ধ থাকলেও বাধ্য হয়েইে পান করতে হয়। যে কারণে তার ৬ বছরের শিশু কন্যা এশা মনি এই অটিজমের শিকার হয়েছে বলে ধারনা করেছে এশা মনির চিকিৎসক। এ জন্য শহিদুল্লাহ খান ও নাজমা বেগম তারা পরবর্তী সন্তান নিতেও ভয় পাচ্ছে।

এ উপজেলার রাজাপুর গ্রামের শাহির রেজা ও তার স্ত্রী সালমা খাতুন জানায়, আজ থেকে সাত বছর আগে তাদের ঘরে একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয় অটিজমের শিকার হয়ে। দেশের নামি দামি হাসপাতালের বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েও কোন লাভ হয়নি। চিকিৎসক বলেছেন তার বাড়ীর নলকুপের পানি আর পান করা যাবেনা। বিষয়টি জানতে পেরে এ বাড়ীর পানি নিয়ে পরীক্ষা করে যমুনা টিভির Investigation 360 Degree টিম। আর তাতে পাওয়া যায় মারাত্মক ফসফেট, সীসা ও মাত্রা অতিরিক্ত আয়রন ও আরসেনিক ।

বেলকুচি পৌরসভার মেয়র বেগম আশানুর বিশ্বাস জানান, এই এলাকার পানি দূষণ থাকায় অটিষ্টিক শিশুর হার দিন দিন বেড়েই চলছে। তাই নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। নির্বাচিত হলে এই অটিষ্টিক শিশুদের জন্য কাজ করবো। সেই জন্য পৌরসভার নিজ তহবিল থেকে অটিষ্টিক শিশুদের জন্য শিক্ষা ও সেবা কর্ণার খুলেছি। তবে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এর প্রসার ঘটানো সম্ভব না।

সিরাজগঞ্জ জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ তবিবুর রহমান তালুকদার, এসব তাঁত শিল্প এলাকার সুতা রং করার প্রসেস ও ডাইং মিলের বিষাক্ত বর্জ্য মিশ্রিত পানি সরাসরি নলকুপের পাইপদিয়ে ভুগর্ভস্থ পানির স্তরে মিশিয়ে দিচ্ছে অসাধু মিল মালিকরা। যে কারণে এ অঞ্চলের নলকুপ গুলোর পানিতে মারাত্মক ডিজল অক্সিজেন, মেগানিস, ফসফেট, সীসা, মাত্রা অতিরিক্ত আয়রন ও আর্সেনিক পাওয়া গেছে।

সিরাজগঞ্জ সরকারী শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ এবং শিশু রোগ বিষেশজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ রফিকুল ইসলাম জানান, যদি কোন গর্ভবতী মা কিংবা শিশু ডিজল অক্সিজেন, মেগানিস, ফসফেট, সীসা, মাত্রা অতিরিক্ত আয়রন ও আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করে তা হলে ঐ গর্ভবতী মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় সন্তান অটিজমের শিকার হতে পারে আবার ছোট শিশুরাও যদি এ পানি পান করে তাহলে তাদেরও একই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।

সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিবন্ধী কর্মকর্তা ফারজানা তাজ জানান, জেলায় প্রায় ৪০ হাজার প্রতিবন্ধীর মধ্যে ২৫ ভাগ শিশুই অটিজমে আক্রান্ত।

সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য প্রফেসর ড. হাবিবে মিল্লাত মুন্না জানান, ভুগর্ভস্থ পানির যথাযথ পরীক্ষার জন্য সরকারের উচ্চ মহলকে কাজ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সেই সাথে জেলার সদর হাসপাতালে অটিজম ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা বিভাগ খোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম সাইফুর রহমান জানান, এ অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষে তামাই ও সমেশপুর গ্রামে দুটি পানি শোধনাগার যন্ত্র বসিয়ে এই এলাকার মানুষের মাঝে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এর প্রকল্প আরো বাড়ানো হবে। আর প্রতিবন্ধী ও অটিজমের শিকার শিশুদের সরকারী ভাতা এবং সকল সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।

টিবিজেড/

Exit mobile version