Site icon Jamuna Television

কখন থামবেন মাশরাফী?

মুরশিদুজ্জামান হিমু

অগ্রজ সাংবাদিক মাহবুব কামালের কলামে একটি গল্প পড়েছিলাম। সেটি দিয়েই শুরু করি।

এক ছেলে ভালো সেতার বাজায়। বাবাও শুনেছেন; ছেলের বাজানোতে মুগ্ধ রীতিমত। তবে, শুধু নিজে মুগ্ধ হলেই তো হবে না, গুনী-সমঝদার কেউ বললেই কেবল ভাল বলা যায়। তাই বাবা তার ছেলেকে নিয়ে ছুটলেন সেতার সমঝদার এক ব্যক্তির কাছে।

ছেলে বাজানো শুরু করেছে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বাবা শুনছেন, শুনছেন সেতারগুরুও। বাজানো অবস্থাতেই বাবা গুরুকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন হচ্ছে? গুরু বললেন, বাজায় তো ভালোই, কিন্তু থামতে জানে তো?

খুব মহামূল্যবান প্রশ্ন করেছেন সেতারগুরু। আসলেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে থামতে জানা দরকার। না জানলে অনেক অর্জনও বিসর্জনের খাতায় নাম লেখাতে পারে কখনও। এটা বোধহয় আধুনিক ক্রিকেটের বিচক্ষণ অধিনায়ক হিসেবে স্বীকৃত মাশরাফী মোর্ত্তজারও অজানা নয়।

আসলেই কখন থামবেন মাশরাফী? বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই কানাঘুষা চলছিল, এই টুর্নামেন্টেই বোধহয় শেষ। এরপরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলবেন ক্যাপ্টেন ফ্যানটাস্টিক। টুর্নামেন্ট যতই এগিয়ে চলছিল, ততই প্রশ্ন আসছিল, আসলেই কি ক্রিকেটকে বিদায় বলছেন নড়াইল এক্সপ্রেস?

একটি সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছেন, আরও কিছুদিন খেলার সামর্থ্য রাখেন। তবে, হুট করে খেলা ছাড়বেন, এটা জানাতেও ভোলেননি। বলেছেন, পরিবার-বোর্ড সবার সাথে আলোচনা করেই নাকি গুডবাই বলবেন ক্রিকেটকে। কিন্তু তার বক্তব্যে খোলাসা নয় কিছুই। আসলেই কি তিনি অবসর নিচ্ছেন? নাকি ‘সামর্থ্য’ অনুযায়ী খেলবেন আরও এক-দেড় বছর? তার একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে এটা জানার আগ্রহ আমার মত আরও লাখো-কোটি বাংলার ক্রিকেটপ্রেমির।

বিশ্বকাপের শুরু থেকেই ফর্মে নেই। আট ম্যাচে উইকেট মাত্র একটি। ইকোনমিও আস্থায় রাখার মত নয়। যে গতি আলাদা করে চেনাতো মাশরাফীকে, তাতো হারিয়েছেন অনেক আগেই। তা হারাবেনই বা না কেন? হাঁটুতে এতবার অস্ত্রোপচারের পর যে এখনও তিনি ক্রিকেট খেলছেন, মাঠ মাতাচ্ছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তা কি কম কিছু? অতিমানবীয় না হলে কি কেউ এটা পারে? নিশ্চয়ই নয়। মাশরাফী একজনই। আমাদের মাশরাফী, আমাদের ক্যাপ্টেন। বুক উঁচিয়ে যে লড়াই করতে শিখিয়েছে দলকে। অভ্যাস করিয়েছে জেতার। কিন্তু তারপরও একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বাস্তবতা কি মানবেন না আপনি? বয়সের রাশ কি টেনে ধরার সামর্থ্য আপনার আছে?

এখন তিনটি বিষয় হতে পারে মাশরাফীর ক্ষেত্রে। এক, পাকিস্তানের সাথে ম্যাচ শেষে হুট করেই দিতে পারেন অবসরের ঘোষণা। দ্বিতীয়ত, কোন কিছু না বলে চুপচাপ থেকে শেষ করবেন বিশ্বকাপ। পরে সুবিধামতো সময়ে বিদায় বলবেন। তৃতীয়ত, পরের কোন সিরিজ বা টুর্নামেন্টের জন্য অবসরের ঘোষণাটা তুলে রাখবেন।

তৃতীয়টি যদি হয়, আর মাশরাফীর এখনকার মতো খারাপ সময়ও যদি চলতে থাকে, তাহলে যা হতে পারে, তা হবে খুবই দুঃখজনক। ফর্ম নিয়ে উদ্দত সমালোচনার ঝড় আরও ফনা তুলবে। তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদায় নিতে হবে তাকে। দ্বিতীয়টি যদি হয়, অর্থাৎ যদি কোন এক সময় চুপচাপ বিদায় বলেন ক্রিকেটকে, তাহলে মাশরাফীর মতো লিজেন্ডের বিদায়টা ঠিকঠাক মতো হবে না। কারণ, তার তো মাঠ থেকেই টুপিখোলা অভিবাদন নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলা উচিত। আর প্রথমটি যদি হয়, তাহলেই বোধহয় মাশরাফীর বিদায়টা ‘মাশরাফীয়’ কায়দায় হতে পারে। বিশ্বকাপের মঞ্চের মতো আর কী থাকতে পারে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলার জন্য?

এখনও চোখ বুজে ‘ক্যাপ্টেন’ ভাবলেই দীর্ঘদেহী ওই মানুষটার কথাই মনে আসে। ইনিংসের বোলিং কে শুরু করবে, তখনই সামনে আসে ওই মাশরাফীর চেহারাই। সহযোদ্ধা কারো বিপদ-আপদ? ক্যারিয়ার কিংবা ব্যক্তিগত বাজে সময়? তখনই কাঁধে সেই মাশরাফীরই হাত। এমন একজন ‘বড়ভাই’ পাশে থাকলে তো হালকা হয়ে যায় অনেক কিছুই। নিজের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কী দেননি মাশরাফী, এমন প্রশ্ন করাই বোকামি। তার মতো ‘যোদ্ধা’র বিদায় স্মরণীয় হবে, এটা তো বেশিকিছু চাওয়া নয়। থামার সময়টা যেন ‘যথাসময়’ হয়, সেটা নিশ্চয়ই খুব ভালোভাবেই জানেন বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক।

Exit mobile version