Site icon Jamuna Television

বিউটি অব ডেভিল (পর্ব ১)

হোসাইন শাহীদ

লাদাখের লে থেকে শ্রীনগর যাচ্ছি। পাহাড়ের বুক চিড়ে আঁকাবাঁকা সড়ক। সমুদ্র পৃষ্ট থেকে প্রায় ১২ হাজার ফুট উচু দিয়ে ছুঁটছে আমাদের গাড়ি। ঘড়ির কাটায় রাত তখন সাড়ে ১১টা। যাত্রী আমরা পাঁচ জন বাংলাদেশী।

গাড়ি চলতে চলতে আমাদের বন্ধু মাহমুদ মাউন্টেন সিকনেসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বেচারা চালকের পাশে চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ তার চিৎকার-আর্তনাদ। গাড়ি থামাও গাড়ি থামাও আমি বমি করবো। শ্রীনগরের বাসিন্দা চালক জাবেদ দ্রুত ব্রেক চাপলেন।

জানিয়ে রাখি জাবেদ আমাদের এই ভ্রমণের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কোন গাড়ি যদি তাকে ওভারটেক করে তাহলে সে ক্ষেপে যায়। আবার তাকে যদি কেউ ওভারটেকের সুযোগ না দেয় তাহলে আরও বেশি ক্ষেপে যায়। টানা তেরো ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে বারো হাজার ফুট উপরে পাহাড় কেটে বানানো ভয়ঙ্কর রাস্তায় ট্রাকের সাথে পাল্লা দেয়ার সেই ঘটনাটা পরে বলছি।

যাই হোক আমি মাহমুদকে গাড়ি থেকে নামালাম। জন মানবহীন পাহাড়ের বুকে বসে বমি করছে মাহমুদ। তাকে ধরে আছি আমি। মনে হচ্ছে সে বমির সাথে নিজের সর্বস্ব ঢেলে দিতে চাচ্ছে। তার অসুস্থতা নিয়ে তেমন একটা ভয়ে ছিলাম না। বমি করতে করতে এমন এক কথা বললো যা শোনার পর ভয়ে আমার শরীর কুকরে গেলো।

মাহমুদ বলছে, আমি এখন আম্মার সাথে ঘুমাবো। আম্মা ও আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরো। একই কথা বারবার বলছে সে। আমি আশে পাশে তাকালাম। চারদিকে বিশাল আকৃতির পাহাড়, আকাশে এক ফালি চাঁদ, এমন পরিবেশে এতোক্ষণ রোমান্টিক লাগলেও এখন মনে হচ্ছে বিশাল দেয়ালের মাঝখানে আমরা বন্দি। পাহাড়গুলো যেনো এক একটা দানব। এখনি গিলে খাবে।

হঠাৎ করে মনে পরলো মাহমুদের ডায়লগ। যাত্রা শুরুতে বলেছিলো- তোমরা ফিট আছো কিনা জানিনা আমার শরীর ফিট আছে, এই ভ্রমণে আমার কোন সমস্যা হবে না। এখন মন চাচ্ছিলো এক লাথি মেরে মাহমুদকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেই। যাই হোক ধরাধরি করে মাহমুদকে আবার গাড়িতে উঠিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। চাঁদকে বামপাশে রেখে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যাচ্ছি আর মনে হচ্ছে ভারত ভ্রমণের শুরুর দিনগুলোর কথা।

বন্ধু আকাশ কয়েকদিন ধরে বলছে চল ভারতের কোথাও ঘুরে আসি। আমি মফস্বলের সাংবাদিক। বিদেশ ঘোরা আমার জন্য গরীবের ঘোড়া রোগের মতো। আমি পাত্তাই দেইনি। একদিন আমার আরেক বন্ধু মাহমুদ, আকাশের কথায় অনেক উৎসাহ নিয়ে রাজি হয়ে গেলো। ভ্রমণের জন্য আরেক সঙ্গী পাওয়ায় আকাশে উঠতে বন্ধু আকাশকে আর ঠেকায় কে? এক রকম জোড় করে আমাকেও রাজি করিয়ে ছাড়লো। আমাদের তিন সদস্য বিশিষ্ট পরিব্রাজক দল গঠনের পর শুরু করলাম দল ভারি করা। আর কাকে কাকে নেয়া যায় এই নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। শেষ পযর্ন্ত কম সময়ে দলের সদস্যদের তালিকা তৈরি হয়ে গেলো। দলে ভিড়লো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ডা: আসিফুর রহমান আকঞ্জি। ছোট বেলায় সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা সিরিজ ছিলো আমার খুব প্রিয়। আর রবিনের চরিত্রটি আমি আকঞ্জির মধ্যে দেখতে পাই। গবেষণা, খোঁজখবর, যাবতীয় খুঁটিনাটি জানতে আকঞ্জির পরিশ্রম রীতিমতো বিরক্ত হওয়ার মতো। তবে কাজের ছেলে সে। এই ট্যুরে সে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। অল্প কিছুদিন হলো বিয়ে করেছে। ভাবিকে রেখে বিদেশ যাত্রার সিদ্ধান্ত তার মতো বীরপুরুষই নিতে পারে।

আর একজন বীরপুরুষ আমাদের সাথে আছে তিনি হলেন ডা. মাহমুদ চৌধুরী। ময়মনসিংহ কমিউনিটি বেসড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার। দলে নেয়া হলো সাগরকেও।

বন্ধু সাগর ঢাকায় থাকে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ব্যস্ত একজন মানুষ। সময় তার সাথে পাল্লা দিয়ে পারে না। সব কাজ গুরুত্ব দিয়ে করে। কাজের প্রতি অতিমাত্রায় সিরিয়াস সে। একবার সে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে একটি বিল্ডিংয়ের নকশা করলো। কম্পিউটারের পর্দায় থ্রিডি লুক দিয়ে নকশাটা দেখছে আর নিজেই নিজের সৃষ্টির প্রেমে পরে যাচ্ছে। নকশা ডেলিভারি দিয়ে পার্টির সামনে বুক টান টান করে বসে আছে প্রশংসা শোনার জন্য। যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো চার তলা বিল্ডিং এর নকশা বানিয়েছেন কিন্তু নিচ থেকে উপরের তলায় উঠার সিড়ি কোথায়? বেলুনটি তখন কিভাবে ফাটলো বোঝার আর বাকি থাকে না।

যাই হোক এই মহা আয়োজন যার প্ররোচনায় হলো তিনি হলেন সৈয়দ হাসানুল ইসলাম আকাশ। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার। নামের আগে সৈয়দ থাকায় একটা ভাব আছে তার মধ্যে। নিজের নিরাপত্তায় জার্মান শেফার্ড পালে সে। আকাশ খাবারের ব্যাপারে বেশ খুঁত খুঁতে, তার খাবার নির্দিষ্ট করা। মেন্যুর বাহিরে খায়না আকাশ। ব্যাপার স্যাপারই আলাদা। শুনেছি রেম্বো মানে তার বিলাতি কুকুরও নাকি তার স্বভাব পেয়েছে।

এই দলের পাঁচ নম্বর সদস্য আমি। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে আমরা এর আগে কেউ  কখনো দেশের বাহিরে যাইনি। স্বাভাবিক ভাবেই উত্তেজনা কাজ করছে সবার ভিতরে।
চলবে..

Exit mobile version