Site icon Jamuna Television

কুহক

(১)

চা’টা শেষ অব্দি হার মেনে নিয়েছে। কিছুক্ষণ আগপর্যন্তও ধোঁয়া উড়িয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। মিনিট পনেরো’র পণ্ডশ্রমের পর এখন অভিমান হয়ে কাপের তলায় জমে আছে।

আমার ঠিক উল্টো দিকের দেয়ালে চারকোলে আঁকা একটা মেয়ের ছবি ঝুলে আছে। এলোমেলো চুল, লম্বা গড়নের মুখ, মুখের অভিব্যক্তি বুঝবার উপায় নেই। আঁকার পর কে যেন এলোমেলো করে ছবিটা কেটে দিয়েছে।

ঘড়ির দিকে চোখ ফেরাতে হল, না আজ আর কোন সম্ভাবনা নেই। অগত্যা বিল মিটিয়ে বাইরে নামতেই অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল গায়ের উপর। চট্টগ্রামের এই এক সমস্যা দশটা না বাজতেই সমস্ত শহর হাই তুলতে থাকে। দু-একটা রিকশা পাশ দিয়ে টুং টাং করে ছুটে যাচ্ছে কিন্তু কারোরই যাত্রী নেবার কোন ইচ্ছে আছে বলে মনে হলোনা। তাই সামনের দিকে হাটা শুরু করতে হল। কিন্তু স্মৃতির ট্রেন ছোটা শুরু করলো পেছনের দিকে।

মাস ছয়েক আগের এক সন্ধ্যা। মেহেদিবাগ নেমে চট্টলকুড়ি স্কুলের পাশ ঘেঁষে যে কানা গলিটা চলে গেছে তারই শেষ মাথায় এ ক্যাফেটার নাম ‘চাতক’। ব্যস্ত শহরে সস্তায় এক কাপ কফি আর একটু নির্জনতার জন্যই এখানে আসা। একটা তাকে পুরনো কিছু বই স্তূপ করে রাখা তারই একটা টেনে নিয়ে এলোমেলো পৃষ্ঠা উল্টে যাচ্ছিলাম। এমন সময় বর্ষা বন্দনায় উন্মত্ত আকাশ ঠিক করল তাড়িয়ে তাড়িয়ে ঘর বেরোনো সব মানুষগুলোকে খোয়ারে পুরবে। মেঘের হাঁকডাক আর বৃষ্টির তোড়জোড়ে তা সফলও হয়েছিল। মানুষজনও তাই তেমন একটা ছিলনা সেদিন।

এমন সময় আধ-ভেজা হয়ে একটা ছেলে যেন পথ ভুলেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ক্যাফেটায়, সঙ্গে একটা ছোট্ট ঝোলা। না ভুল করে নয়, বোধ হয় বাধ্য হয়ে। ক্যাফের ম্যানেজার উঠে এসে হাত মেলাল, “আরে শুভানন দাদা দেখি, এই ঝড় বাদলার মধ্যে?”

-“আর বলো না, এসেছিলাম একটা গানের অনুষ্ঠানে, ঝড় বাদলে প্রোগ্রামতো ভেস্তে গেলই আমাকেও আটকে পড়তে হল। তা কফি টফি হবে নাকি?”

-“আপনি বসুন আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

ছেলেটা আমার তিন টেবিল সামনে একটা চেয়ার দখল করে দু-হাত দিয়ে চুল থেকে বৃষ্টির পানি ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছে।

এদিকে ইতস্তত করতে থাকা ইলেক্ট্রিসিটি চোখ বুঝতেই অন্ধকার তার প্রসারিত ডানার মাঝে লুকিয়ে নিল এই ঘরটাকেও।

ক্যাফের ম্যানেজার একটা মোম দিয়ে গেল। মোমের মিহি আলো যেন ছেলেটার অধর লেহন করে হারিয়ে যাচ্ছিল ওর চুলের মাঝে। এর মাঝেই ছেলেটা তার ঝোলা থেকে একটা বাঁশি বের করে আজ মালহার রাগ ধরলো। বৃষ্টির শব্দের সাথে বাঁশির রাগ মিলেমিশে যেন এক করুন আঁচড় কেটে যাচ্ছিল নিস্তব্ধতার গায়ে। এমন সময় অন্ধকারের কুকুন থেকে বেরিয়ে এলো একটি সদ্যজাত প্রজাপতি। উড়তে উড়তে এসে বসল আমার বুকের পরে। প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর শব্দ ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত চরাচরে।

সেদিন মেসে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। মহসিন কলেজের পাশেই ছোট্ট গলির ভেতর পুরনো বাড়ির ছাদে চিলোকোঠা একটি ঘর। দুটো রুম সেখানেই চারজনের থাকা। ঘরে এসে বিছানায় গড়িয়ে পড়তেই মনে জেগে উঠলো অন্ধকার ঘরের সেই সৌম্য গৌর কান্তিমুখ। মাঝেমাঝে হয় না একটা সুর এমন ভাবে পথ আটকে ধরে যে পালাবার পথ থাকে না। বারবার শুনে আওড়েও নিস্তার নেই। তেমন করে সেই মুখ তার সুর আটকে রইল আমার মনের ভেতর।

(২)

-জানতো এ ফুলের নাম কিন্তু মাধবীলতা নয়, এর নাম মধুমঞ্জুরি। এর নাম দিয়েছিলো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। দূর থেকে বোঝার উপায় নেই কিন্তু কাছে গেলেই একটা মিষ্টি গন্ধ। এ ঠিক তোমার মতো। আমার গালের কাছটা গরম হয়ে উঠলো। সেখানে শুভানন আলতো হাত রেখে মুখটা তুলে ধরতেই সমুদ্রের এক বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়লো পায়ে।

একটা খুটখুট শব্দ আবছা থেকে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ঘুম ভাঙ্গার পর কিছুক্ষণ সময় লাগলো বুঝতে কোথায় আছি। জানালার কাচে একটা কাঠঠোকরা অনবরত ঠোকর দিয়ে ঘোরটা ভেঙ্গে দিল। পাশ ফিরে বাসি মুখেই আওড়ালাম শুভানন শুভানন শুভানন। নামটা অনুপ্রাসের মত লেগে রইল আমার মুখে।

অবেলায় কে এলো? অনবরত দরজায় কড়া নাড়বার শব্দে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দরজা খুলতে হল। বুকের ভেতর তুমুল ঝড় আর মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম। দরজার ওপাশে শুভানন। গতকালের স্বপ্নের সাথে এর কতটুকু তফাৎ?

-আপনার ব্যাগ, গতকাল ক্যাফেতে ফেলে এসেছিলেন। এর ভেতর একটা চিঠির খাম ছিল সেখান থেকে ঠিকানাটা পাওয়া।

ভেতরের সমস্ত উত্তেজনা চেপে বললাম থ্যাঙ্কু। ভেতরে আসুন প্লিজ।

-একাই থাকেন?

-না। আরও তিনজন আছে। বাকিদের ফাইনাল শেষ হলো তাই বাড়ি চলে গেছে সবাই।

একথা সেকথার পর বংশীবাদকের পরিচয় পাওয়া গেল। বাঁশিটাই প্যাশন আর জীবিকার জন্যে একটা কোম্পানির ডাটা এন্ট্রি অপারেটর।

-আচ্ছা আপনাদের শহরটার সমস্যা কি বলুনতো? রান্নার জন্য গ্যাস পাওয়া যায়না, ঠিকমতো জলও নেই আর জিনিসপত্রের চড়া দাম।

-এতো মানুষের সৃষ্টি, শহরের কি দোষ বলুন। এ শহরের হয়ে আপনার কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থী। প্রকৃতি এতো উজাড় করে দিয়েছে যেহেতু আপনি একে ক্ষমা করে দেবেন নিশ্চিত।

-প্রার্থনা মঞ্জুর করা হল।

-তাহলে আজ সন্ধ্যায় প্রবারণার উৎসবে নিমন্ত্রণ রইলো আপনার।

সন্ধ্যায় শুভানন আমাকে নন্দনকানন নিয়ে গেলো এখান থেকেই উৎসবটা শুরু হয়। একটা একটা করে ফানুস উড়ছিলো আর লোকজনের সেকি উল্লাস। সেখান থেকে আমরা চলে গেলাম কর্ণফুলীর তীরে। নদীর এপার থেকে ওপার আট টাকায় পারাপার। আমরা একটা নৌকায় চড়ে বসলাম।

শুভাননের বাঁশির সুর কেটে কেটে নৌকা এগিয়ে চলছিল। সেখান থেকেই আমায় দেখালো প্রবারণার আসল রূপ। দিগন্ত থেকে একটি একটি করে ফানুস এসে ছেয়ে যাচ্ছিলো সমস্ত আকাশে। আর দু একটা টুপটাপ করে ডুব দিচ্ছিল নদীর জলে।

এতো ফানুস! আমার চোখে জল চলে এলো। ও আমার হাত ধরে বললো “কি হল?”
বলে উঠলাম, বাতাসে খুব লবণ। হো হো করে হেসে উঠলো শুভানন। সে হাসির সুর ভেঙে পড়ছিলো জলের তোড়ে। সেদিন থেকে সেই বিশ্বস্ত হাতের মুঠোবন্দি হয়ে রইল আমার হাত।আর এ শহরের হয়ে জবাবদিহি করবার যে ভার সে নিয়েছিলো তা পূরণ করে দিল ষোলোআনা।

আমরা দুটো নিশি পাওয়া মানুষ রাত পালিয়ে ঘুরে বেরাতে লাগলাম শহর জুড়ে, যেখানে পথ শেষ হয়েছে আরেক পথে। শুভানন আমার আঁচল ভরে দিত কখনো রবীন্দ্রনাথ কখনো সুনীল কখনো জয় গোস্বামীর কবিতায়। নীরবতার দণ্ডে দণ্ডিত শহরকে ও মুক্তি দিতো ওর সুরের মূর্ছনায়।

একদিন আমায় একটা পাথর উপহার দিয়ে বলেছিলো ডাউকি নদীর পাড়ে যেখানে জল এতো স্বচ্ছ যে নৌকোগুলোকে মনে হয় শূন্যের উপর ঝোলান সে নদীর পাথর এটা, এ রইল তোমার কাছে আমার এক গোপন চুমুর মতো সমস্ত পৃথিবীর পক্ষে অজানা। পাথরটা আমার কাছে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো হয়ে উঠলো। যখনই ওর কথা খুব মনে পড়তো আমি পাথরটার গায়ে হাত বুলাতাম আর মনে মনে ডাকতাম “শুভানন শুভানন শুভানন।” এমন করে আমার জল হাওয়া ঢেউ খেলছিলো ওর সুরে, আর ওর সুর পথ হারাচ্ছিলো আমার পথে।

এর মধ্যে আমার রুমমেটদের ছুটি ফুরিয়ে এলো। ওরা ফেরবার পর আমি উচ্ছ্বাস নিয়ে বললাম শুভানন এর কথা। পৃথিবীকে আমাদের গল্প শোনাবার জন্য যেন আর তর সইছিলনা।

প্রথমে ওরাও বেশ আগ্রহ দেখালো। কিন্তু শুভানন এর সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দেবার পর থেকে ওরা কেমন অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করলো। কেমন ভয় আর আতঙ্ক মিশ্রিত চোখে তাকাতো আমার দিকে। তার পরদিনই বাড়ি থেকে হঠাৎ আমার বোন এসে উপস্থিত। “মা পাঠিয়েছে দিদি বাড়ি চল এখানে আর একা থাকতে হবে না। “আমি বললাম শুভাননকে ছাড়া আমিতো কোথাও যেতে পারবো না। ওকেও সাথে নিয়ে নেই?

শুভকে ডেকে বললাম তুমি যাবে তো আমার সঙ্গে? ও কেবল হাসলো। কিন্তু আমার বোন কেনো জানি খুব কাঁদলো। সবাই মিলে জোর করে আমকে একটা মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল।

শুভানন নাকি আমার মস্তিষ্ক প্রসূত!  আমার অসুস্থ মস্তিষ্কের কল্পনা! যাকে আমি আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করলাম তা মিথ্যে কেমন করে হয়?

প্রথম দিকে শুভানন খুব সঙ্গ দিলেও ডাক্তারদের মুখে হাসি ফুটিয়ে এক সময় সে আসা ছেড়ে দেয়। তারা আমাকে রিলিজ করে বাড়ি পাঠিয়ে দিল বোনের সঙ্গে। আর বারণ করে দিল যাতে আমাকে একা না রাখা হয়।

সেদিন এ শহরকে বিদায় জানিয়ে আমার সেই মফস্বল শহরে পাড়ি জমাচ্ছিলাম। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে মেহেদিবাগ পেরিয়ে গোলপাহাড় এসে উঠলাম।

“পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থি।”

এ কণ্ঠস্বর! আমার সমস্ত আত্মা কেঁপে উঠল।
-“তুমি পালাচ্ছ,মুক্তি?”
-তুমি বাস্তব নও। তুমি কল্পনা। ডাক্তার বলেছে আমার স্বপ্ন দেখা বারণ।

ও দুহাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার মাঝেই সৃষ্টি আমার, তোমার মাঝেই বিস্তার। আজ আমার বিনাশের ভার ও তুমি নিলে?

মন চাইল বলি, তোমার জন্য সমস্ত জগত সংসার অস্বীকার করে নিলাম। তোমার মাঝে বৃত্তাবর্ত আমি এই শুধু একমাত্র সত্য। কিন্তু মুখে বললাম তুমি স্বপ্ন তুমি মিথ্যে। তোমার আমার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে বাস্তব, তোমার বিনাশই আমার অর্থহীন বেঁচে থাকার মানে।

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই আমি চোখ বুজে হাঁটা শুরু করলাম।

তারপর আমি আর কোনদিন চোখ খুলিনি

(লিখেছেন: ফারজানা ওমর তানজু)

Exit mobile version