তালহা বিন জসিম⚫
গত শুক্রবার (৩০ মে) সন্ধ্যায় টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকবাহী নৌকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর আগেও এই ঘটনা ঘটে। এমন অগ্নিকাণ্ড একটি গুরুতর নিরাপত্তা সমস্যা। অগ্নিকাণ্ডের ফলে সম্পদের ক্ষতি এবং পর্যটন খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ সমস্যার সমাধানে নিম্নে কিছু আলোচনা করা হলো।
শুরুতে পর্যটকবাহী নৌকায় অগ্নিকাণ্ডের কিছু কারণ জেনে নেই।
গ্যাস সিলিন্ডার ও রান্নার চুলা ব্যবহার:
অনেক নৌকায় পর্যটকদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে গিয়ে রান্না করার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করছে। কিন্তু গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের যে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা দরকার বেশির ভাগ নৌকায় সে ব্যবস্থা থাকেনা। এছাড়া রান্না ঘরের এতো ছোট হয়ে থাকে যে সেখানে একবার আগুন লাগলে অগ্নি নির্বাপণের সুযোগ পাওয়া যায় না। রান্না ঘরের চুলা ও গ্যাস সিলিন্ডারের অন্তত তিন ফুট দূরত্বে অন্যান্য সামগ্রি রাখতে হয় অগ্নি নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু বেশির ভাগ নৌকায় রান্না ঘরের এতবড় স্পেস থাকে না। এছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার মেয়াদ না দেখে কেনা, নিরাপত্তা নিয়ম না মানা, পুরনো বা মানহীন সিলিন্ডার ব্যবহার, সিলিন্ডারের সংযোগ স্থান লিকেজ আছে কিনা তা প্রতিদিন পরীক্ষা না করার কারণে অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটে থাকে।
বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট:
নৌকায় অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। নৌকায় সৌর প্যানেল, জেনারেটর, ব্যাটারির মাধ্যেমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হলেও অনেক সময় নিম্ন মানের তার ও ওয়ারিং ঠিকমতো করা হয় না। এতে অনেক সময় ওভারলোডিংয়ের ফলে শর্টসার্কিট হয়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে।
সিগারেট এর শেষাংশ:
অনেক পর্যটক নৌকায় ধূমপান করেন এবং সিগারেটের শেষাংশ পানিতে না ফেলে কাঠের নৌকায় ফেলেন। বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর তথ্য বলছে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের জন্য দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো বিড়ি সিগারেটের শেষাংশ। ২০২৪ সালে সারাদেশে বিড়ি সিগারেটের জলন্ত টুকরা থেকে ৪১৩৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তাই এবিষয় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
খোলা আগুনের ব্যবহার:
অনেক সময় পর্যটকরা নৌকার উন্মুক্ত স্থানে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিয়েই বারবিকিউর জন্য চুলা ব্যবহার করে থাকেন। এখান থেকে অসতর্ক থাকলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়া আতশবাজি ও ফানুস উড়ানো থেকেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। তাই খোলা আগুন ব্যবহারের সাবধান হতে হবে।
নৌকার কাঠামো দাহ্য হওয়া:
বেশিরভাগ নৌকা কাঠের তৈরি, ফলে একবার আগুন লাগলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া নৌকার ডেকোরেশনের জন্য অতি দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এজন্য অগ্নিকাণ্ড ঘটলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্ষতি বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া নৌকার রুমগুলো এতো ছোট হয়ে থাকে যে অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল বা আগুন প্রতিরোধী ব্যবস্থা থাকে না। এতে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে অতি প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে।
অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষায় কী কী নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে, এবার আলোচনা করা যাক সম্পর্কে।
নৌকায় অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র বাধ্যতামূলক করা:
প্রতিটি পর্যটকবাহী নৌকায় এবিসি টাইপ অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র থাকতে হবে, যা তেল, বৈদ্যুতিক এবং অন্যান্য দাহ্য পদার্থের আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা যায়। এবং কতটি অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র রাখতে হবে তা নির্ভর করে কতজন পর্যটক এখানে থাকেন ও নৌকার আকার এবং দাহ্য পদার্থের ব্যবহারের উপর। এজন্য নৌকা নির্মাণের পর ফায়ার সার্ভিস এর পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। এছাড়া শুধু অগ্নিনিবাপণ যন্ত্র রাখলেই হবে না তা নৌকার সবাইকে ব্যবহার জানতে হবে। এজন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
গ্যাস ও চুলার ব্যবহারে সতর্কতা:
বেশির ভাগ নৌকায় রান্নার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়, যা ঝুঁকিপূর্ণ। সেজন্য রান্নার জন্য নির্ধারিত নিরাপদ এলাকা রাখা। গ্যাস সিলিন্ডার নিয়মিত পরিদর্শন ও মানসম্মত সংযোগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
নৌকায় বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ:
নৌকায় বৈদ্যুতিক তার ও সংযোগের মান খারাপ হলে শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লাগতে পারে। সেজন্য সার্কিট ব্রেকার (MCB) ব্যবহার বাধ্যতামূলক। বৈদ্যুতিক কাজ লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইলেকট্রিশিয়ান দিয়ে করানো। মাসে অন্তত একবার বৈদ্যুতিক লাইনের নিরাপত্তা পরিদর্শন করা।
জরুরি বহির্গমন পরিকল্পনা ও মহড়া:
যেহেতু পর্যটকবাহী নৌকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। তাই এরকম দুর্ঘটনায় পর্যটকরা কিভাবে নৌকা থেকে জরুরি বহির্গমন করবেন তা নৌকায় দৃশ্যমান জায়গায় লিখে রাখতে হবে। এবং ভ্রমণ শুরুতে এ বিষয়ে পর্যটকদের ব্রিফিং করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বছরে অন্তত ২ বার জরুরি বহির্গমন এর ফায়ার ড্রিল আয়োজন করা।
নৌকা নির্মাণ ও কাঠামোতে নিরাপত্তা মান নিশ্চিত করা:
যেহেতু বেশিরভাগ পর্যটকবাহী নৌকা কাঠের তৈরি এই নৌকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এহন্য পর্যটক পরিবহনকারী নৌকাগুলোতে কাঠের বদলে লোহার সুরক্ষিত কাঠামো ব্যবহার উৎসাহিত করা উচিত। এছাড়া সরকার ও বিআইডব্লিউটিএ এর অনুমোদিত ডিজাইন অনুযায়ী নৌকা নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া কাঠ ব্যবহার করলে কাঠের উপর অগ্নিপ্রতিরোধী ব্যবস্থা ব্যবহার করা যেতে পারে।
নৌকার লাইসেন্স ও সেফটি সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করা:
নৌযানগুলো যেন নিয়মিত সেফটি চেক এবং ফিটনেস সার্টিফিকেট গ্রহণ করে তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে করে নৌকার নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত হবে তেমনি পর্যটকরাও নিরাপদ থাকার আস্থা তৈরি হবে।
নৌকা চালক ও স্টাফদের ফায়ার সেফটি প্রশিক্ষণ:
চালক ও সহকারীদের জন্য ফায়ার সেফটি ও ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা উচিত। শুধুমাত্র চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনলে হবে না নৌকার বাবুর্চিদের সবার আগের অগ্নি নির্বাপণের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কেননা দুর্ঘটনার সময় কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে হয়, তা তারা জানেন না, ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এব্যপারে নৌকার মালিকদের এগিয়ে আসা উচিত। তারা এই প্রশিক্ষণের জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর সহযোগিতা নিতে পারে।
লেখক : তালহা বিন জসিম, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন অফিসার
Leave a reply