ইউরোপজুড়ে ফুটবল উৎসবের মৌসুমে শিরোপা জয়ের আনন্দ মাঝেমধ্যেই কলুষিত হচ্ছে সহিংসতায়। সম্প্রতি লিভারপুলের পর গতকাল রোববার (২ মে) প্যারিসেও শিরোপা উদযাপনের সময় অপ্রীতিকর ঘটনার ঘটেছে। প্রশ্ন উঠেছে – এই আনন্দের মুহূর্তগুলো কেন হিংসায় রূপ নিচ্ছে?
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (২৭ মে) ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জয় উদযাপন করতে লিভারপুল শহরের রাস্তায় জমায়েত হওয়া হাজারো সমর্থকদের মাঝে হঠাৎ ছুটে আসে একটি গাড়ি। আচমকা ওই গাড়ির ধাক্কায় গুরুতর আহত হন ২৭ জন। আহতের মধ্যে চারজন শিশু রয়েছে। লিভারপুল পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৫৩ বছর বয়সী এক শ্বেতাঙ্গ বৃটিশ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি সন্দেহভাজন চালক।
প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, ঘটনাটি পরিকল্পিত হামলা নয় এবং এ ঘটনায় আর কারো জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি।
এ ঘটনার ভিডিও ইতোমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। লিভারপুল ওয়েস্ট ডার্বির এমপি ইয়ান বার্নে এক বিবৃতিতে বলেছেন, এই ঘটনা ‘হৃদয়বিদারক’। এক্স (টুইটার)-এ পোস্ট করা বিবৃতিতে তিনি লিখেছেন, ‘সবচেয়ে সুন্দর দিন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শহরে যা ঘটেছে তা দেখে আমি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছি। আমার ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা সকল ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য।’
অন্যদিকে, উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গতকাল ইন্টার মিলানকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে ফরাসি ক্লাব পিএসজি। ফাইনালে প্যারিস সেন্ট-জার্মেইনের (পিএসজি) চমকপ্রদ ৫-০ জয়ের পর ফ্রান্সের প্যারিসের রাস্তায় নেমে আসে হাজারো ভক্তরা। এ বিজয় উদযাপনের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় পিএসজি সমর্থকরা। রাতভর এ সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়েছে। সেই সাথে গ্রেফতার করা হয়েছে অনেক সমর্থকদের বলে জানিয়েছে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কিছু সমর্থকের জন্য আনন্দ প্রকাশের সীমা অতিক্রম করে সহিংসতায় রূপ নেয়। শিরোপা উদযাপনের সময় মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান সহিংস আচরণকে উসকে দেয়। এমনকি, শান্তিপূর্ণ ভক্তদের মধ্যে কয়েকজন অস্থিতিশীল ব্যক্তির উপস্থিতি পুরো পরিবেশ নষ্ট করে দেয়।
উভয় শহরেই পুলিশ কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছিল, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এখন প্রশ্ন উঠেছে – শিরোপার আনন্দ যাতে বিপর্যয়ে রূপ না নেয়, সে জন্য কী ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি নেয়া যায়?
প্রথমত, এসব ঘটনার পর পুলিশি টহল ও সিসি ক্যামেরা বৃদ্ধি করা অতীব প্রয়োজনীয়। এছাড়াও স্টেডিয়াম বা উদযাপন এলাকায় মদ্যপান সীমিত করা যেতে পারে। কারণ—মাদক সেবনের পর মানুষের মধ্যে উগ্র মনস্তাত্ত্বিক বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে।
দ্বিতীয়ত, যেকোনো খেলা রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের মানুষদের একত্রিত করে। সেই সাথে কিশোর-কিশোরী থেকে বৃদ্ধ—প্রায় সব বয়সের মানুষ পরিবারসহ খেলা উপভোগ করতে উপস্থিত হন মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে। তাই, সরকারের তরফ থেকে নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা।
তৃতীয়ত, সহিংসতা এড়াতে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রায় সব তারকা খেলোয়াড় এবং ইনফ্লুয়েন্সিয়াল রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে যুক্ত থাকেন। ক্লাব কিংবা পেয়ারদের গণসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন ভক্তদের অনুপ্রেরণা দিতে পারে। বিশেষকরে, যেকোন সহিংসতা ঘটার পূর্বে করনীয় কাজের বিষয়ে সতর্কবার্তা প্রচার করা যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এছাড়াও, বিভিন্ন মানবিক সংস্থাগুলোর ওয়েবসাইট কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজ থেকে সহিংসতা নিয়ে গণসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন প্রচার করা যেতে পারে। এছাড়াও স্থানীয় মিডিয়াগুলোতেও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সতর্কবার্তা প্রচার করতে পারে, যাতে করে শহরের জনগণ এবং অভিভাবকরা সচেতন থাকতে পারে।
ফুটবল আনন্দের খেলা, কিন্তু অপ্রত্যাশিত সহিংসতা এই আনন্দকে মাটি করে দিতে পারে মুহূর্তের মধ্যেই। তাই অতীতের ভুলগুলো থেকে শিখে ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ উদযাপনের সংস্কৃতি গড়ে তোলাই এখন ক্লাব কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি নিউজ
/এআই
Leave a reply